আলোকময় কুরআন ২০২৪
আলোকময় কুরআন
লেখকঃ প্রফেসর হামিদুর রহমান (রহ:)
জুমু'আর দিন। এ দিনে সূরা কাহাফ তিলাওয়াতের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। এটা পনের পারায় শুরু হয়ে ষোল পারায় শেষ হয়েছে। এ সূরার প্রথম আয়াত হলো,
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا.
অর্থ: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি তার দাসের উপরে নাযিল করেছেন এই কিতাব এবং এর মধ্যে কোন জটিলতা রাখেননি। (সূরা কাহাফ-১)
প্রশ্ন হতে পারে, কোন জটিলতা না থাকলে কুরআনের এত ব্যাখ্যা কেন? যেমন, সূরা নূরের এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন,
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ مَثَلُ نُورِهِ كَمِشْكَاةٍ فِيهَا مِصْبَاحٌ الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ يُوقَدُ مِنْ شَجَرَةٍ مُبَارَكَةٍ زَيْتُونَةٍ لَا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ نُورٌ عَلَى نُورٍ يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
অর্থ : আল্লাহ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের জ্যোতি, তাঁর জ্যোতির উদাহরণ যেন একটি কুলঙ্গি, যাতে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচপাত্রে স্থাপিত, কাঁচপাত্রটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ। তাতে পুতঃপবিত্র যাইতুন বৃক্ষের তৈল প্রজ্বলিত হয়, যা পূর্বমুখী নয় এবং পশ্চিমমুখীও নয়। অগ্নি স্পর্শ না করলেও তার তৈল যেন আলোকিত হওয়ার নিকটবর্তী। জ্যোতির উপর জ্যোতি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ দেখান তাঁর জ্যোতির দিকে। আল্লাহ মানুষের জন্যে দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন এবং আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত। (সূরা নূর-৩৫)
এটা এত কঠিন আয়াত যে, যুগ যুগ ধরে সমস্ত মুফাসসিরে কুরআন এই আয়াতের উপরে অনেক গবেষণা করেও নিশ্চিত সমাধানে পৌছতে পারেননি। এমনকি আজ থেকে এক হাজার বছর আগে ইমাম গাযালী রহ. এই আয়াতের উপর বিরাট তাফসীর গ্রন্থ লিখেছেন।
সুতরাং কুরআনে জটিলতা না থাকার কথাটি পুরোপুরি মিললো না। এ আপত্তির উত্তরে উলামায়ে কেরাম বলেন যে, হ্যাঁ, এ ধরনের আয়াতের গভীরতায় পৌঁছানোর জন্য অনেক গভীর ইলম প্রয়োজন। কিন্তু সব আয়াত এমন নয়। যেসব আয়াতে দৈনন্দিন সাধারণ বিধি- বিধান আছে, সেগুলো যে কোন মানুষ বুঝতে পারে। এভাবে যে আয়াতগুলো বোঝা আমাদের প্রয়োজন, সেগুলোকে আল্লাহ তা'আলা অকল্পনীয় সহজ করে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা অধিকাংশ সময় প্রয়োজনীয় কথা বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে মাথা ঘামাই। যেমন, উল্লিখিত সূরা নূরের আয়াতটিতে প্রয়োজনীয় বিধানাবলী নেই। এ আয়াতটির সুনিশ্চিত মর্ম বোঝা সহজ নয়। পৃথিবীর সব উলামায়ে কেরাম মিলে যদি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত গবেষণা করেন তবু নির্দিষ্ট সমাধানে পৌঁছতে পারবেন না। এমন আয়াতগুলোর ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ হলো, এগুলো তিলাওয়াত করো; সওয়াব পাবে। আর বিশ্বাস রাখো, এ আয়াতে আল্লাহ যা বলেছেন, সত্য বলেছেন; যদিও আমরা তা বুঝতে পারি না। এটাই আমাদের প্রতি আল্লাহ তা'আলার আদেশ। অপর একটি আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,
تَبَارَكَ الَّذِي جَعَلَ فِي السَّمَاءِ بُرُوحًا وَجَعَلَ فيهَا سِرَاجًا وَقَمَرًا مُنِيرًا.
অর্থ: মহা বরকতময় সেই সত্তা যিনি আকাশে বুরুজ (Stellar Formation) বানিয়েছেন এবং তাতে সূর্যকে বানিয়েছেন প্রদীপ ও চাঁদকে বানিয়েছেন নূর। (সূরা ফুরকান-৬১)
এখানে কুরআন বলছে, He has made the moon a light and made the sun a lamp। এই আয়াতে চিন্তা করার অনেক সুযোগ আছে। ইংরেজি শিক্ষিত- যারা কুরআন নিয়ে চিন্তা করেন- তাদের জন্য চিন্তার উপকরণ আছে।
চৌদ্দশ বছর আগে কুরআন মাজীদ চাঁদের জন্য কী শব্দ ব্যবহার করেছে, আর সূর্যের জন্য কোন শব্দ এটা চিন্তা করার বিষয়। সে সময় মানুষ জানতো না, চাঁদের যে হালকা আলোয় দুনিয়া আলোকিত হয়, সেটা চাঁদের নিজস্ব আলো নয়; বরং সূর্যের আলোর প্রতিফলন। তখনো এটা আবিষ্কার হয়নি। অথচ কুরআন তখনকার দিনের মানুষের জন্য সহজ ও মানানসই শব্দ ব্যবহার করেছে। এটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু কেউ যদি এই গবেষণা শুরু করে যে, আল্লাহ চাঁদকে নূর বললেন, আবার আল্লাহ নিজেকেও নূর বলেছেন, তাহলে এই গবেষণা অনর্থক। এমন গবেষণার কোন কূল-কিনারা পাওয়া যাবে না। সূরা বাকারায় আয়াতুল কুরসীর এক আয়াত পরে আছে,
اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إلى النور.
অর্থ: যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে নূরের দিকে। (সূরা বাকারা-২৫৭)
এই আয়াতে 'নূর' অর্থ হিদায়াত বা কুরআন অথবা রাসূলের তরীকা। কাজেই 'নূর' শব্দের অনেক অর্থ আছে। আমাদের কর্তব্য হল, সহজ-সরল বিষয়গুলো মানা। আর যে বিষয়গুলো কঠিন বলা হয়েছে সেগুলোতে মাথা না ঘামানো। কুরআনের কঠিন বিষয়ে মাথা ঘামানো বোকামী এবং সময়ের অপচয়। হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. বার বার বলতেন, কুরআন মাজীদের তিলাওয়াত বড় দামী জিনিস। হযরত মাওলানা আবরারুল হক রহ. কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতের ব্যাপারে প্রায়ই বলতেন যে, মসজিদে যাওয়ার পর যদি দেখা যায় নামাযের এখনো এক মিনিট সময় বাকী আছে, তবু একটি কুরআন শরীফ নিয়ে তিলাওয়াত করা উচিত। এক মিনিট যেতে না যেতেও যদি মুয়াযযিন সাহেব ইকামত দেয়া শুরু করেন তবু কিছু আসে যায় না। কারণ এই এক মিনিটেই যদি কমপক্ষে এক লাইনও পড়া হয় তাহলে এক লাইনে পঁয়ত্রিশটি হরফ ধরে প্রতি হরফে দশটি করে নেকী হিসেবে তিনশ পঞ্চাশ নেকী হবে। আখিরাতে একটি নেকীর জন্য মানুষ আফসোস করবে। তাই দুনিয়ায় একটি নেকী অর্জন আসলে মস্ত বড় উপার্জন। মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, 'নেকী কী এখন বোঝ না। নেকী হল কবরের পরের জীবনের ফরেন কারেন্সি।' মক্কা শরীফে বাংলাদেশের টাকা চলে না। (অবশ্য আজকাল কিছু চলে। একশ টাকার নোট, পাঁচশ টাকার নোট এখন মক্কা শরীফে গ্রহণ করে।) আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে যদি পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে আপনি কিছু কিনতে যান, সবাই আপনাকে বোকা বলবে। সেখানে ডলার লাগবে। তেমনি কবরের জীবনে সোনা-রূপা, পয়সা-কড়ি কিছুই কাজে আসবে না। সেখানে কাজে আসবে নেকী। অথচ এই নেকী অর্জনেই আমরা গাফেল।
নেকী কামাইয়ের সহজ সহজ সুযোগকে আমরা অনর্থক আলোচনায় নষ্ট করি। আমরা গবেষণা করি, মি'রাজের সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম আসমানে হযরত আদম আ.কে কেন পেলেন? আদম আ. এর মর্যাদা কি তাহলে কম? বেকার, একদম বেহুদা চিন্তা-ভাবনা। বলে যে, আমি বহুদিন ধরে খুব চিন্তা করছি, ব্যাপারটা কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম আসমানে আদম আ. কে পেলেন কেন? তারপর আরেক আকাশে গিয়ে অমুককে পেলেন কেন? এসব তত্ত্ব- তালাশ, চিন্তা-গবেষণা একেবারে অনর্থক, বেকার। এগুলোতে কোন ফায়দা নেই। বরং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথে যে বিষয়গুলো উপকারী সেগুলোতে সময় দেয়া উচিত। সহজ কাজ হলো, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা, মাসআলা-মাসাইল শেখা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহজ সুন্নাতগুলো আঁকড়ে ধরা। এ ধরনের নেকীর কাজে বেশি বেশি সময় দেয়া উচিত। আল্লাহ তা'আলা সূরা কাহাফের প্রথম আয়াতে বলেছেন,
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَل لَهُ عِوَجًا.
অর্থ: সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি নিজের বান্দার প্রতি এ গ্রন্থ নাযিল করেছেন এবং তাতে কোন বক্রতা রাখেননি। (সূরা কাহাফ-১)
ভূমিকাটি কী অদ্ভুত! আল্লাহ তা'আলা নিজের কথার মধ্যে নিজেই ভূমিকা দিচ্ছেন। ভূমিকা কী? আলহামদুলিল্লাহ! বলুন, আলহামদুলিল্লাহ। কী অদ্ভুত পদ্ধতি বলার! আগে নিজে আলহামদুলিল্লাহ বলাচ্ছেন বান্দাকে দিয়ে। বল, আলহামদুলিল্লাহ। যে মহান আল্লাহ কিতাব নাযিল করেছেন তার বান্দার উপরে যার মধ্যে কোন প্যাঁচ নেই। প্যাঁচ না থাকার কথাটি এভাবে বুঝতে হবে যে, যে কথা সাধারণ দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে তা অতি সহজ করে বলা হয়েছে।
এ ধরনের আরো একটি আয়াত আছে সূরা ক্বমারে। আয়াতটি আল্লাহ তাআলা এই সূরায় চারবার বলেছেন। আয়াতটি হল,
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِر .
অর্থ : আমি এ কুরআনকে বড় সহজ করে দিয়েছি যিকিরের জন্য। (সূরা ক্বমার-১৭)
মুফাসসিরীনে কেরাম বলেন, যিকিরের অর্থ দু'টি। একটি হল মুখস্থ করা। অর্থাৎ মুখস্থ করার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। আরেকটা হল, নসীহত গ্রহণ করা। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনের অতি সহজ- সরল নসীহত, যা যে কোন মানুষ গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ মুখস্থ করার জন্য ও নসীহত গ্রহণ করার জন্য আমি কুরআনকে বড় সহজ করে দিয়েছি। তারপর বলেন, فَهَلْ مِنْ مُدَّكِر (অর্থ) কোন চিন্তাশীল আছে কি?' আছে কেউ এটা মুখস্থ করবে? আছে কেউ এখান থেকে নসীহত গ্রহণ করবে?
আপনি চিন্তা করেন, বলার পদ্ধতিটা কী রকম! 'আমি কুরআনকে বড় সহজ করে দিয়েছি মুখস্থ করার জন্য, নসীহত গ্রহণের জন্য।' এ পর্যন্ত বললে তো বাঁচতে পারতাম। তারপরে বলেন, 'আছে কেউ এটি মুখস্থ করবে? আছে কেউ এখান থেকে নসীহত নেবে?' যেন আল্লাহ তা'আলা ভিখারীর মত আমাদের দুয়ারে দুয়ারে রাতের বেলায় দিনের বেলায় বলছেন যে, হে বান্দা তোমাকে বানিয়েছি আমি। মায়ের পেটে অন্ধকারে বানিয়েছি আমি। একটা ফোঁটা থেকে বানিয়েছি আমি। তোমার টলটলে চোখ দুটো দিয়েছি আমি। তোমার ঐ সুন্দর চেহারা দিয়েছি আমি। বান্দা! তোমার একটু সময় হবে, আমার কালামে মাজীদ শুদ্ধ করে পড়বে, শিখবে? আমরা জবাব দিই, আমার সময় নেই। বাস্তবে আমাদের আমল কি এ রকম নয়? কুরআন মাজীদের এই সূরার মধ্যে চার-চারবার আল্লাহ এই কথাটি বললেন, فَهَلْ مِنْ مُدَّكِر . অর্থাৎ আছে কেউ, সময় হবে আমার কালামকে একটু দেখার? একটু বোঝার? একটু পড়ার? একটু শেখার? আমাদের জবাব কী হয়? আমার সময় নেই। আমার এখন ইস্টার্ন রিফাইনারীতে ডিউটি আছে। বলা হয়, আচ্ছা তাহলে আপনার বাচ্চাটিকে একটু মসজিদে পাঠাবেন? কুরআন শরীফ পড়াব। বলে, এখন পরীক্ষার পর ক্যাডেটে ভর্তির জন্য কোচিং-এ ক্লাস করে; সময় নেই। বাপেরও সময় নেই, ছেলেরও সময় নেই। অথচ সময় দিয়েছেন আল্লাহ।
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
أَوَلَمْ يَرَ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُبِينٌ وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَنَسِيَ خَلْقَهُ
অর্থ: মানুষ কি দেখে না যে, নিশ্চয়ই আমি তাকে সৃষ্টি করেছি বীর্য থেকে? অতঃপর তখনই সে হয়ে গেল প্রকাশ্য বাকবিতণ্ডাকারী। সে আমার সম্পর্কে এক অদ্ভুত কথা বর্ণনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টিকে ভুলে যায়। সে তার নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যায়। (সূরা ইয়াসীন-৭৭-৭৮)
সে বরং উল্টো আমার সঙ্গে ঝগড়া করে,
قَالَ مَنْ يُحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ.
অর্থ: কে আবার এই মরা হাড়গুলোকে জীবিত করবে? (সূরা ইয়াসীন-৭৮)
আল্লাহর শব্দ অপূর্ব মিষ্টি! মানুষ কি দেখে না, তাকে আমি একটা ফোঁটা থেকে বানিয়েছি। সে আমার সঙ্গে প্রকাশ্যে ঝগড়া করে। আর আমার কথা বলে, কে নাকি পয়দা করবে? সে ভুলে যায় তার সৃষ্টিকে। কী মিষ্টি শব্দ! এরূপ আপনি আমিও বলি। একটা এতিম ছেলেকে আপনি লালন-পালন করেছেন। আপনার বাড়িতে রেখে খাইয়েছেন, পরিয়েছেন। তাকে উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন। ডিগ্রি পাস করিয়েছেন। এম এ পাস করিয়েছেন। এখন সে আপনাকে চেনে না। আপনি কী বলবেন? নিজেকে নিজে বলবেন, তার জন্য এতো এতো করলাম! আর সে কিনা....। তো বান্দা সম্পর্কে আল্লাহ পাক আমাদের মতো করেই কথা বলছেন! আমার বান্দা আমাকে আজকে চেনে না। আমার সম্পর্কে এ রকম কথা বলছে! তাকে কীভাবে বানিয়েছিলাম, সে ভুলে যায়। সূরা কাহাফের মধ্যে আছে,
أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلًا
অর্থ : তুমি কি সেই মহান রবকে অবিশ্বাস করলে, যিনি মাটি থেকে বানিয়েছেন তোমাকে, একটা ফোঁটা থেকে বানিয়েছেন তোমাকে, কী অপূর্ব সুন্দর আকৃতিতে তোমাকে একটা মানুষ বানিয়েছেন তিনি। (সূরা কাহাফ-৩৭) তিনটি কথা আল্লাহ একই সঙ্গে বলেছেন। মাটি থেকে বানিয়েছেন তোমাকে, একটা ফোঁটা থেকে বানিয়েছেন তোমাকে এবং পরিপূর্ণভাবে তোমাকে একটা মানুষের আকৃতি দিয়েছেন। তাঁকে তুমি অবিশ্বাস কর? আমরা খুব সহজেই বলব, আমরা কোনদিন আল্লাহকে অবিশ্বাস করি না। আমরা সবাই আল্লাহকে মানি। কত আমল করি, কত যিকির করি! কুরআনের এই দাবী, أكَفَرْتُ بِالَّذِي (অর্থ) 'তুমি কি অবিশ্বাস কর?' এই আয়াতের ব্যাপারে আমরা সবাই পাস করব। কিন্তু যখন ঐ সূরা ক্বমারের আয়াত আসবে, আল্লাহ পাক যেখানে বলেছেন,
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ
অর্থ: আমি এই কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্য, মুখস্থ করার জন্য, আছে কেউ একটু সময় দিবে? (সূরা ক্বমার-১৭)
কী জবাব দেব আমরা? আমি আজকে যে আয়াতটা তিলাওয়াত করেছি সেখানেও একই রকম। আল্লাহ তা'আলা আবারো ভূমিকা করেন,
تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا
অর্থ: বরকতময় সেই মহান সত্তা, যিনি নাযিল করেছেন তার দাসের উপরে ফুরকান (এখানে কুরআনের নাম দিয়েছেন ফুরকান। ফুরকান অর্থ যা দিয়ে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ করা যায়), যাতে সে হয় সমগ্র জগতের জন্য সতর্ককারী। (সূরা ফুরকান-১)
আল্লাহ কুরআন মাজীদে বলেন,
يَا أَيُّهَا الْمُدَّيْرُ. قُمْ فَأَنْذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ.
অর্থ: হে কাপড় আবৃত ব্যক্তি! উঠুন, দাঁড়ান, মানুষকে সতর্ক করুন। আপনার রবের বড়াই বর্ণনা করুন। (সূরা মুদ্দাসসির-১-৩)
কাব্বির অর্থ হল, আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর। কাব্বির শব্দের আমলী জবাব হল, আল্লাহু আকবার।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হয়েছে, মানুষকে নসীহত কর। মনে করিয়ে দাও, এমন একটা দিন আসবে যেদিন কিছুই কাজে আসবে না। সেদিনের প্রস্তুতি গ্রহণ কর। সূরা বাকারায় আয়াতুল কুরসীর ঠিক আগের আয়াত,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ
অর্থ : ঐদিন আসার আগে খরচ কর (কোথায় খরচ করতে হবে এটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ), যেদিন কোন কেনা-বেচা কাজে আসবে না। কোন আত্মীয়তা কাজে আসবে না। কোন সুপারিশ কাজে আসবে না। অবিশ্বাসীরাই জালেম। (সূরা বাকারা-২৫৪)
জুমু'আ নামায সম্পর্কে কুরআনে কারীমে আছে,
فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ.
অর্থ: দৌড়াও যিকিরের দিকে, নামাযের দিকে। কেনা-বেচা ছেড়ে দাও। (সূরা জুমু'আ-৯)
জুমু'আর দিনে আযানের পরে কেনা- বেচা হারাম। আপনি এখন চিন্তা করুন, আমাদের অনেক ভাই জুমু'আর নামাযের আযানের পরে দোকান খোলা রাখে কিনা? অথচ কুরআনের ভাষায় হারাম। আমাদের উচিত তাদের দাওয়াত দেয়া, ভাই! জুমু'আর আযানের পরে কেনা- বেচা করো না; এটা হারাম। একথা আমাদেরই বলতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজ আমাদেরই কাজ। ঐ যে সূরা ইউসুফের আয়াত আপনাদের শুনালাম,
قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي
অর্থ: আপনি বলুন, এটি আমার কাজ আমি আল্লাহর দিকে ডাকি, আমি এবং যে কেউ আমাকে অনুসরণ করে। (সূরা ইউসুফ-১০৮)
তার মধ্যে আমি-আপনারা সবাই শামিল। যেকোন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করল, তার একটা কর্তব্য হল আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়া। আর আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার ব্যাখ্যা হল, হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুরো শরীয়ত, প্রতিটি হুকুম যেগুলো আমাদের জন্য সহজ-সরলভাবে প্রযোজ্য সেগুলো অন্যকে বলতে হবে। আমি শুধু আমল করলাম, কাউকে কিছু বললাম না- এটা ভদ্রলোকের কাজ? না, ভদ্রলোক কাউকে কিছু বলে না, এটা ভুল।
কাজেই আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সজাগ হবার সৌভাগ্য দিন। আমাদের দায়িত্বকে বুঝে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের দীনকে যিন্দা করার জন্য যা কিছু দিয়ে সম্ভব চেষ্টা করতে হবে। আমার আমল নেই, এজন্য কাউকে কিছু বলব না, এটা ভুল। আমাকে দাওয়াত দিতে হবে। হতে পারে, যাকে দাওয়াত দিলাম তিনি আমলে আগে বেড়ে যাবেন। ইনশাআল্লাহ তার সওয়াব আমার কপালে জুটবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের উত্তম বুঝ নসীব করুন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের পথে অগ্রসর হওয়ার সৌভাগ্য দিন। তার সুন্নাতগুলোকে যিন্দা করার লক্ষ্যে মেহনত করার সৌভাগ্য নসীব করুন। আ-মীন।
সংগ্রহ: মাওলানা মাহমূদুল আমীন
মুদীর, মা'হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া, বছিলা গার্ডেন সিটি, মুহাম্মদপুর, ঢাকা