coinpayu

হজ্জ সম্পর্কে কিছু দিকনির্দেশনা ২০২৪

 

হজ্জ সম্পর্কে কিছু দিকনির্দেশনা

মুফতী মনসূরুল হক দাঃ বাঃ



[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত]

হামদ ও সালাতের পর...

হযারাতে উলামায়ে কেরাম, বুযুর্গানে মুহতারাম ও সর্বস্তরের মুসলমান ভায়েরা! আজ আমাদের ইজতিমা ইসলাম নামক ইমারতের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ 'হজ্জ'কে কেন্দ্র করে। যা হযরত আদম আ. থেকে শুরু হয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। হজ্জ জীবনে একবার ফরয হয়। নগদ টাকা না থাকা সত্ত্বেও কারো জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটবে না, সংসার অচল হয়ে পড়বে না, হজ্জের যাতায়াত খরচও স্বাভাবিকভাবে হয়ে যাবে, কারো কাছে এই পরিমাণ বাড়তি সম্পদ থাকলে তার উপর হজ্জ ফরয হয়। যদিও তার কাছে নগদ টাকা না থাকে । উদাহরণস্বরূপ কারো ১০ বিঘা জমি আছে, কিছু জমি বিক্রি করলে হজ্জ করা যায়, তেমন কোন অসুবিধা হয় না তাহলে জমির কিছু অংশ বিক্রি করে তাকে হজ্জে যেতে হবে। অনেকে মনে করে নগদ ৩ লাখ টাকা না থাকলে হজ্জ ফরয হয় না। অনেকে চাকুরী শেষে এককালীন কয়েক লাখ টাকা পেনশন পেয়ে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে লাভ (সুদ) খেতে থাকে। মনে করে এ টাকা তো এখন উঠানো যাবে না অতএব আমার উপর হজ্জ ফরয না। অথচ মাসআলা হল, এক বছর সংসার চলে এ পরিমাণ টাকা রেখে বাকি টাকা দিয়ে হজ্জ আদায় করতে হবে। এরপরও অবশিষ্ট থাকলে কোন হালাল জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারে। ব্যাংকে রেখে সুদ খেতে খেতে মারা গেলে আল্লাহর কাছে কী জবাব থাকবে? এভাবে অনেকে ভুলের মধ্যে আছে। হজ্জ ফরয হওয়া সত্ত্বেও আদায় করে না। উলামায়ে কেরামের নিকট মাসআলাও জিজ্ঞাসা করে না।

হজ্জ যে বছর ফরয হয় ঐ বছর করা ওয়াজিব। আমার বাড়ির কাজ শেষ হয়নি, ব্যবসা এলোমেলো, মেয়ে বিবাহ দেয়া বাকি, এগুলো নিছক বাহানা; শরীয়তে এগুলো ওযর হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিলম্ব করলে প্রত্যেক বছর ওয়াজিব তরকের গুনাহ হবে। 

যদিও পরে করলে ফরয আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু বিগত বছরগুলোর গুনাহের শাস্তি কে ভোগ করবে? দেরি করতে নিষেধ করার কারণ হলো, অনেক সময় টাকা হাত ছাড়া হয়ে যায়, শরীর সুস্থ থাকে না, হায়াত শেষ হয়ে যায়, তখন হজ্জ না করেই দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়। হজ্জ না করে মারা গেলে হাদীস শরীফে কঠিন ধমকি এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এমন ব্যক্তি ইয়াহুদী হয়ে মরুক বা খ্রিস্টান হয়ে মরুক আমি কোন পরোয়া করি না। (সুনানে তিরমিযী; হা. নং ৮১২)

হজ্জ করতে শক্তির প্রয়োজন হয়। অনেক দৌড়ঝাঁপের কাজ আছে। যুবক বয়সে গেলে সুন্দরভাবে হজ্জ করা যায়। অনেকে বৃদ্ধ বয়সে যায়। তাদের পক্ষে ২০/৩০ লাখ মানুষের মধ্যে তাওয়াফ করা, সায়ী করা, কঙ্কর মারা যথাযথভাবে সম্ভব হয় না। অন্যের মাধ্যমে করাতে হয়। এজন্য শক্তি থাকতে হজ্জ করা উচিত। মালয়েশিয়ার ছেলে-মেয়েদের হজ্জ না করলে বিবাহই হয় না। তারা সকলেই যুবক বয়সে হজ্জ করে আর আমরা বেশির ভাগ বৃদ্ধ বয়সে হজ্জ করি।

হজ্জ যদিও জীবনে একবার ফরয হয় তবে এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা যাকে শারীরিক সুস্থতা এবং আর্থিক সামর্থ্য দান করেছেন, তার জন্য (কমপক্ষে) প্রতি পাঁচ বছরে একবার বাইতুল্লা'য় উপস্থিত হওয়া উচিত। (সহীহ ইবনে হিব্বান; হা. নং ৩৭০৩) কারণ ফরয নামাযের জামা'আত চলাকালীন সময়টুকু ছাড়া বাকি পুরোটা সময় এ ঘরের তাওয়াফ চালু রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মানুষ জীবনে শুধুমাত্র একবার হজ্জ করলে কিভাবে তা চালু থাকবে? যতদিন আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দেন হজ্জে-উমরায় যেতে থাকেন। 

হজ্জের মধ্যে অনেক নসীহত রয়েছে। ইহরামের কাপড় স্মরণ করিয়ে দেয়— বড় বড় মার্কেট, বাড়ি, শিল্প-কারখানা সব অন্যের সম্পদ; তোমার সম্পদ দু'টো সাদা কাপড় আর যা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে আগে পাঠিয়ে দিয়েছ তা।

আমাদের দেশের লোকেরা হজ্জের সফরে সাধারণত তামাত্তু' করে। অর্থাৎ প্রথমে উমরার জন্য ইহরাম বাঁধে। উমরা শেষ করে সাধারণ পোশাকে অবস্থান করে। এরপর হজ্জের পূর্বে নতুন করে হজ্জের জন্য ইহরাম বেঁধে হজ্জ করে। উমরার মধ্যে দু'টি কাজ ফরয। ইহরাম বাঁধা, বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা। আর দু'টি কাজ ওয়াজিব। সাফা মারওয়া সায়ী করা, মাথা মুণ্ডানো। 

উমরার বিবরণ


প্রথমে উমরার মাসআলা সংক্ষেপে বর্ণনা করছি। উমরার জন্য প্রথমে ইহরাম বাঁধতে হয়। ইহরাম হল, অবাঞ্চিত লোম, নখ ইত্যাদি কেটে, পাক সাফ হয়ে গোসল করে পুরুষের জন্য শরীরের নিচের অংশে মোটা চাদর এবং গায়ে আরেকটি চাদর পরিধান করা (আর মহিলাদের জন্য তাদের সাধারণ পোশাকই পরিধান করা)। এর পর দুই রাকা'আত নামায পড়ে সালাম ফিরিয়ে নিয়ত করা। এই দুই রাকা'আত নামায সুন্নাত। নিয়ত এই- اللهم إني أريد العمرة فيسرها لي وتقبلها مني অর্থ : হে আল্লাহ! আমি উমরার নিয়ত করছি। আপনি আমার জন্য সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে কবুল করে নিন।

আরবীতে না পারলে বাংলায়ও নিয়ত করা যাবে। নিয়ত করে তালবিয়া পড়লে ইহরাম বাঁধা হয়ে গেল। অনেকে শুধু ইহরামের কাপড় পরিধান করাকে ইহরাম মনে করে।

অনেকে ইহরামের কাপড় লাগেজে দিয়ে দেয়। এয়ারপোর্টে গিয়ে ইহরামের কাপড় পরিধান করার সময় দেখে লাগেজ বিমানে ঢুকে গেছে। তাদেরকে আমরা একটা সহজ কৌশল শিখিয়ে দেই যে, ইহরামের কাপড়ের ব্যবস্থা করতে না পারলে আপনি পেরেশান হবেন না। একসময় বিমানে ঘোষণা হবে 'আধা ঘণ্টা পর বিমান ল্যান্ড করবে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা মীকাত অতিক্রম করব তখন বিমানের সিটে বসে সাধারণ কাপড়েই ইহরামের নিয়ত করে তালবিয়া পড়ে নিবেন এতেই ইহরাম বাঁধা হয়ে গেল। বিমানবন্দরে নামার পর ইমিগ্রেশন হয়ে গেলে লাগেজ খুলে তখন ইহরামের কাপড় পরে নিন। তাতে সর্বোচ্চ দুই ঘন্টা সাধারণ লেবাসে থাকা হয়। এর কারণে দম ওয়াজিব হবে না। দিনের বেশির ভাগ সময় সাধারণ লেবাস পরা থাকলে দম ওয়াজিব হয়। অর্থাৎ একটি বকরী কুরবানী করতে হয়। এতে আনুমানিক চার শ রিয়াল পড়ে। যা গরীবরা খেতে পারবে, আপনি পারবেন না। মাসআলা জানা থাকলে অনেক কিছু সহজ। না জানার কারণে অনেকে ইহরাম ছাড়াই মীকাত অতিক্রম করে গুনাহগার হয়।

তো ইহরাম চাদর পরিধানের নাম নয়; নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার নাম ইহরাম। তালবিয়া নিজে নিজে পড়তে হবে। সম্মিলিতভাবে পড়া অনুচিত। তালবিয়ার মধ্যে চারটি বাক্য আছে, যা চার শ্বাসে পড়তে হয়-


لبيك اللهم لبيك 

لبيك لا شريك لك لبيك

إن الحمد والنعمة لك والملك لا شريك لك 


অনেকে তৃতীয় বাক্যটি তিন টুকরো করে পড়ে। প্রথমে إن الحمد বলে থামে। তারপর والنعمة বলে আবার থামে। এরপর لك والملك বলে। অর্থাৎ চারটি বাক্য চার শ্বাসে না পড়ে সাত শ্বাসে পড়ে। এটা অনুচিত। চার বাক্য চার শ্বাসেই পড়ার নিয়ম। তালবিয়াতে لا شريك لك বাক্যটি দু'বার উল্লেখ করে বুঝানো হয়েছে যে, ঈমান শিরকমুক্ত না হলে কোন মূল্য নেই। হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. এর তালীমুদ্দীন, আমার লেখা কিতাবুল ঈমান যার সংক্ষেপ এসো ঈমান শিখি- এসব কিতাব থেকে দৈনন্দিন একটা করে পয়েন্ট মসজিদে মসজিদে তা'লীম শুরু করুন। তাহলে মানুষের ঈমান সহীহ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তা'লীমের সাথে সাথে দাওয়াতের মেহনতও করতে থাকেন যাতে ঐ কথাগুলো দিলে বসে যায়।

তালবিয়া 

তো দুই রাকাআত নামায পড়ার পর নিয়ত করে তালবিয়া পড়ার দ্বারা ইহরাম হয়ে গেল। এখন বেশি বেশি তালবিয়া পড়তে থাকুন। বন্ধু-বান্ধবের সাথে সাক্ষাত হলে সালামের পূর্বে তালবিয়া, নামায শেষে ইসতিগফারের পূর্বে তালবিয়া, উপরে উঠা ও নিচে নামার সময় তালবিয়া মোটকথা সব জায়গায় তালবিয়া জারি রাখুন।

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ 

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহের মধ্যে কিছু আল্লাহ তা'আলার হকের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, গুনাহ করা যাবে না। গুনাহ করলে হজ্জে মাবরূর বাতিল হয়ে যায়। কবুল হজ্জের বিনিময় জান্নাত। তাই কিছুতেই গুনাহ করা যাবে না।

কিছু বিষয় নিজের শরীরের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, নখ, মোচ, চুল কাটা এবং পুরুষের জন্য মাথা, চেহারা এবং জুতা বা মোজা দ্বারা পা ঢেকে রাখা। তবে কাঁথা বা লেপ দিয়ে মাথা ও চেহারা বাদ দিয়ে পুরো শরীর ঢাকা যাবে। আর কিছু পোশাকের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, শরীরের গঠনে সেলাই করা পোশাক পরিধান করা। খোশবু ব্যবহার করা। সুগন্ধি সাবান ব্যবহার করা ইত্যাদি। এগুলোও করা যাবে না। পানের সাথে সুগন্ধ জর্দা খাওয়া যাবে না। কিছু বিষয় বিবির সাথে সম্পৃক্ত যদি বিবি সাথে থাকে। যেমন, তার সাথে মহব্বতের কথা বলা যাবে না। মহব্বত করার তো প্রশ্নই আসে না।

কিছু অন্যান্য হাজীদের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, তাদের সাথে ঝগড়া-ফাসাদ, হাতাহাতি, মারামারি ইত্যাদি অশোভন আচরণ করা যাবে না। কিছু বিষয় জীবজন্তুর সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, কবুতর, হরিণ বা কোন প্রাণী শিকার করা যাবে না। মাছি ও ছারপোকা মারা যাবে না। তবে মশা, সাপ ও পাগলা কুকুর মারা যাবে। পালা হাঁস- মুরগীও জবাই করার অনুমতি আছে। যাই হোক, বিমান একসময় জেদ্দা বন্দরে অবতরণ করবে। সেখানে প্রত্যেক দেশের মানুষের জন্য আলাদা আলাদা বিশ্রামাগার আছে। আপনি বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত স্থানে চলে যাবেন। লাগেজ সেখানের কুলিরাই বহন করবে। আপনি সাথে ছোট একটা হাতব্যাগ রাখবেন। জরুরী ঔষধ, টাকা, টিকিট ইত্যাদি জিনিস সবসময় হাতব্যাগ অথবা কোমর ব্যাগে রাখবেন। লাগেজে রাখবেন না। অনেক সময় লাগেজ পেতে দেরি হয়। তখন এসব জরুরী জিনিস সাথে না থাকলে ঝামেলায় পড়তে হয়। বিমানবন্দর থেকে মুয়াল্লিমের গাড়ি আপনাকে মক্কায় নিয়ে যাবে। যারা আগে মদীনায় যাবেন তাদের জন্য দেশ থেকে ইহরাম বাঁধার প্রয়োজন নেই। ইহরাম ছাড়াই মদীনায় যাবেন। মক্কায় আসার পথে মদীনা থেকে ৬ মাইল দূরে 'যুল হুলাইফা' নামক স্থানে গাড়ি থামবে। সেখানে বিশাল মসজিদ আছে। উযূ- গোসলের সুন্দর ব্যবস্থা আছে। আপনি উযূ-গোসল সেরে এ মসজিদ থেকে ইহরাম বাঁধতে পারবেন। মক্কায় পৌঁছার পর ঘর্মাক্ত লেবাসে, ক্লান্ত শরীরে তাড়াহুড়ো করে মসজিদে যাবেন না। বরং কিছু খেয়ে, গোসল ইত্যাদি সেরে ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করে বাইতুল্লা'য় গিয়ে উমরার তাওয়াফ করবেন। নবীজী হজ্জের সফরে যী-তুয়ার একটি মহল্লায় রাত্রি যাপন করেছেন। সকালে গোসল করে পরিচ্ছন্ন হয়ে ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করার পর বাইতুল্লা'য় প্রবেশ করেছেন।

তাওয়াফ করার পদ্ধতি 

মাতাফে (তাওয়াফের স্থানে) যেতে হয় মসজিদে হারামের ভেতর দিয়ে। অতএব মসজিদে প্রবেশের পাঁচটি সুন্নাত আদায় করবেন। কিছুদূর অগ্রসর হলে বাইতুল্লাহ নযরে পড়বে। বাইতুল্লাহ নযরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালবিয়া পড়া বন্ধ করে দিন। এ সময় দু'আ কবুল হয়। সুতরাং খুব দু'আ করবেন। যা মনে চায় দু'আ করবেন কিন্তু ঈমানের সাথে মৃত্যু নসীব হওয়ার দু'আ করতে ভুলবেন না। এরচে বড় কোন দু'আ নেই।

দু'আ করে সামান্য অগ্রসর হলে মাতাফ। মসজিদে হারাম থেকে সামান্য নিচু। মাতাফে এসে তালবিয়া বন্ধ করুন। তাওয়াফ মাতাফ দিয়েও করা যায়; আবার মসজিদে হারামের দোতলা, তিনতলা এবং ছাদেও করা যায়। সুযোগ থাকলে নিচ দিয়েই করবেন।

নতুন তাওয়াফের শুরুতে ইজতিবা করতে হবে (শরীরের চাদর ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের ওপর রাখা এবং ডান কাঁধ খোলা রাখা)। ইজতিবা করে হাজরে আসওয়াদের দিকে যাবেন । মসজিদের যে দিকে সবুজ টিউব লাইট এবং একটিমাত্র মিনার আছে হাজরে আসওয়াদ সে দিকে অবস্থিত। মসজিদুল হারামের সব দিকেই জোড়া মিনার। শুধু হাজরে আসওয়াদের দিকে একটি মিনার। বাইতুল্লাহর কোনায় হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করা। মাথা প্রবেশ করালে পাথরের সাথে মুখ ছোঁয়ানো যায়। আপনারা মুখ লাগাতে চেষ্টা করবেন না; দূর থেকে ইশারা করবেন। কারণ সেখানে আতর মাখানো থাকে। 

ইহরাম অবস্থায় আতর লাগানো নিষেধ। আবার বিভিন্ন দেশের বিশালদেহী মানুষের ভীড় থাকে। তাদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করতে গেলে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

নবীজী বিদায় হজ্জে হাজরে আসওয়াদে মুখ লাগিয়ে চুমু দেননি। যাতে পরবর্তী দুর্বল উম্মত চুমু খেতে না পারলে মন খারাপ না করে। যা হোক, তাওয়াফের শুরুতে আপনি বাইতুল্লাহর দক্ষিণ পূর্বকোণে হাজরে আসওয়াদের দিকে মুখ করে দু'আ করবেন, হে আল্লাহ আপনার ঘর তাওয়াফ করার নিয়ত করছি। সহজ করে দিন এবং কবুল করে নিন। নিয়ত করে তাকবীরে তাহরীমার মতো কান বরাবর হাত উঠিয়ে باسم الله الله اكبر ولله الحمد , বলে ছেড়ে দিবেন। এরপর হাজরে আসওয়াদের দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করে  باسم الله الله اكبر বলে আওয়াজ ছাড়া হাতে চুমু দিবেন। তারপর সীনা সোজা করে তাওয়াফ শুরু করবেন। প্রথম তিন চক্করে রমল করবেন। অর্থাৎ বাহাদুরের মত হেলেদুলে চলবেন (এভাবে চলাকে রমল বলে)। যে সকল সাহাবায়ে কেরাম রাযি. মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গিয়েছিলেন মক্কার কাফেররা মদীনার আবহাওয়া ইত্যাদির কারণে তাদেরকে দুর্বল মনে করত। সাহাবায়ে কেরাম রাযি. প্রথমবার বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করতে আসলে মক্কার কাফেররা বাইতুল্লাহর উত্তর পার্শ্বের এক পাহাড়ে সমবেত হয়েছিল মদীনা থেকে আগত লোকদের তামাশা দেখার জন্য। ভেবেছিল দুর্বলতার কারণে তারা উদ্যমের সাথে তাওয়াফ করতে পারবে না। হযরত জিবরাইল আ. এর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা নবীজীকে বিষয়টি অবহিত করলে নবীজী সাহাবায়ে কেরাম রাযি. কে প্রথম তিন চক্করে রমল করার হুকুম দিলেন।

তো তাওয়াফের প্রত্যেক চক্করে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে ঘুরে প্রথম বারের মত হাজরে আসওয়াদের দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করে باسم الله الله اكبر বলে আওয়াজ ছাড়া হাতে চুমু দিবেন। এরপর সীনা সোজা করে আবার চলা শুরু করবেন। তাওয়াফের শুরুতে একবার এবং প্রত্যেক চক্করের শেষে একবার মোট আটবার চুমু দিতে হবে। তাওয়াফের সময় কুরআন তিলাওয়াতের চেয়ে যিকিরের সওয়াব বেশি। সুবিধার জন্য আমিও যিকিরের একটা পদ্ধতির কথা বলি। এর দ্বারা চক্কর গণনার জন্য হাতে সাত দানার ভাসবীহ রাখার প্রয়োজন হবে না। যিকিরই স্মরণ করিয়ে দিবে যে, আপনি কত নম্বার চক্করে আছেন। পদ্ধতিটা হল, কালিমায়ে সুওম سبحان الله والحمد لله ولااله الاالله والله أكبر এর মধ্যে চারটি বাক্য আছে। প্রথম চার চক্করে এ বাক্যগুলো পড়বেন। অর্থাৎ প্রথম চক্করে سبحان الله। দ্বিতীয় চক্করে ا والحمد لله তৃতীয় চক্করে ولااله الاالله চতুর্থ চক্করে والله أكبر। পঞ্চম চক্করে বুখারী শরীফের শেষ হাদীস سبحان الله وبحمده سبحان الله الْعَظِيمِ। ষষ্ঠ চক্করে যে কোন দুরূদ শরীফ এবং সপ্তম চক্করে যে কোন ইস্তিগফার। প্রত্যেক চক্করে বাইতুল্লাহর দক্ষিণ পাশে এসে ربنا اتنا في الدنيا حسنة وفي الاخرة حسنة وقنا عذاب النار পড়বেন। এই সাত চক্কর মিলে এক তাওয়াফ হল। সপ্তম চক্করে শুরু থেকেই একটু একটু করে একেবারে কিনারায় চলে যাবেন। তাহলে তাওয়াফের কাতার থেকে বের হতে মোকাবেলা করতে হবে না। এখন কাজ হল, মাকামে ইবরাহীম এবং বাইতুল্লাহ একসাথে সামনে হয়, সম্ভব হলে এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে দু'রাকাআত নামায পড়ুন। তাওয়াফের শুরুতে ইজতিবার জন্য আপনার ডান কাঁধ খোলা রেখেছিলেন এই দুই রাকাআত নামাযের সময় কাঁধ ঢেকে নিন। তাওয়াফ ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত বা নফল হোক তাওয়াফ শেষে দুরাকাআত নামায পড়া ওয়াজিব। হাজরে আসওয়াদ বরাবর কিনারায় অনেক পানির কল দেয়া আছে। নামায শেষে সেখানে গিয়ে তৃপ্তি সহকারে যমযমের পানি পান করুন। তওয়াফের কাজ এখনেই শেষ। 

সাফা মারওয়ার সায়ী 

এখন সাফা মারওয়া সায়ী করতে হবে। সায়ী করা ওয়াজিব। সাফা-মারওয়া মসজিদুল হারামের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত। মাকামে ইবরাহীম বরাবর পূর্ব দিকে যমযমের পানি পানের স্থানে লেখা আছে বাবুস সাফা। তো সাফা পাহাড়ে উঠে বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে হাত তুলে দু'আ করুন। দু'আ শেষ করে ডান পাশ দিয়ে নেমে মারওয়ার দিকে চলতে থাকুন। মাঝখানে সবুজ বাতি দ্বারা চিহ্নিত স্থানে সামান্য দ্রুত হাঁটবেন। এ স্থানে অনেকে দৌড়ায়। দৌড়ানোর কোন বিধান নেই। বাকি জায়গায় স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে উত্তর মাথায় মারওয়ায় যান। মারওয়ার উপরে উঠেও বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে দু'আ করবেন। সাফা থেকে মারওয়ায় গেলে এক চক্কর হয়। অনেকে সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফায় আসলে এক চক্কর গণনা করে, এটা ভুল। তো সাত সায়ীতে আট বার দুআ করবেন এবং গণনা ঠিক রাখার জন্য তাওয়াফের মত সাত চক্করে পূর্বের সাত তাসবীহ পড়তে পারেন। সায়ীর শেষে দুই রাকা'আত নামায পড়া সুন্নাত। মসজিদেও পড়া যায় মসজিদের বাইরেও পড়া যায়। সায়ীতে তাওয়াফের ন্যায় কোন ইজতিবা নেই। সুতরাং কাঁধ খোলা রাখতে হবে না। এরপর চতুর্দিকে সমান করে মাথার চুল কাটতে হবে। রাস্তার পার্শ্ব থেকে কাটাবেন না। সেলুনে কাটাতে পারেন অথবা মেশিন কিনে নিতে পারেন। তাহলে মাথা যখম হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। সায়ীর পর মাথা মুণ্ডানোর সাথে সাথে আপনি হালাল হয়ে গেলেন। উমরার কাজ শেষ। এখন গোসল ইত্যাদি সেরে সাধারণ পোশাক পরিধান করতে পারেন। এখন আপনি স্বাভাবিক নিয়মে মক্কায় অবস্থান করতে থাকেন। জামা'আতের সাথে নামায আদায় করেন, দু'আ, যিকির, কুরআন তেলাওয়াত, এবং নফল তাওয়াফ করতে থাকেন। সাথে মহিলা থাকলে নামাযের জন্য তাদেরকে মক্কায় মসজিদুল হারামে বা মদীনায় মসজিদে নববীতে নিবেন না। তারা যেখানে অবস্থান করবে সেখানে নামায পড়াই তাদের জন্য বেশি সওয়াব। তাওয়াফ বা সায়ী করতে গিয়ে অথবা নবীজীর রওজা যিয়ারত করতে গিয়ে নামাযের সময় হয়ে গেলে তখন পড়তে পারে। উভয় মসজিদেই তাদের জন্য নামাযের ভিন্ন ব্যবস্থা আছে। তবে ওয়াক্তিয়া নামায পড়ার জন্য মহিলাদেরকে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। 

হজ্জের বিবরণ

৭ যিলহজ্জের রাতে ইশার নামাযের পর মু'আল্লিমের গাড়ীতে আপনাদেরকে মিনায় নেয়া হবে। ঐ দিন নিজ বাসায় বা মসজিদে গিয়ে পূর্বের নিয়মে ইহরাম বাঁধবেন। অর্থাৎ পাক সাফ হয়ে গোসল করে ইহরামের কাপড় পরিধান করবেন। এবং মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে দুই রাকা'আত নামায পড়ে হজ্জের নিয়ত করবেন। হজ্জের নিয়ত এই- اللهم إنى أريد الحج فيسره لي وتقبله منى অর্থ : হে আল্লাহ! আমি হজ্জের নিয়ত করছি। আপনি সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে কবুল করে নিন। আর বদলী হজ্জ হলে নিয়তের সময় তার নাম উল্লেখ করে বলতে হবে, হে আল্লাহ! আমি অমুকের পক্ষ থেকে হজ্জের নিয়ত করছি, আপনি সহজ করে দিন এবং তার পক্ষ থেকে কবুল করে নিন। বাকি সব কাজ এক। নিয়ত করে একবার তালবিয়া পড়ার সাথে সাথে হজ্জের ইহরাম বাঁধা হয়ে গেল। এখন জরুরী কিছু সামানা সাথে নিয়ে বড় লাগেজ মক্কায় বাসায় রেখে যাবেন।

মিনায় অবস্থান

মুয়াল্লিমের গাড়ীতে মিনায় গিয়ে নির্ধারিত তাঁবুতে অবস্থান করতে থাকেন। যাওয়ার সময় টয়লেটগুলো কোনদিকে খেয়াল করবেন। এরপর তাঁবু থেকে নম্বর দেখে দেখে টয়লেটে যাবেন, যাতে নম্বর মিলিয়ে আবার নিজ তাঁবুতে পৌঁছতে পারেন। তাঁবুর মধ্যে পর্দা টানিয়ে মহিলাদেরকে আলাদা করে দেন। তাদের দরজাও পুরুষদের থেকে ভিন্ন। পর্দার মধ্যে দরজা দেয়া আছে। আট তারিখ সারা দিন মিনায় অবস্থান করুন। খানা-পিনা ও নামায ছাড়া এখানে আর কোন আমল নেই। মুয়াল্লিমকে খানার জন্য টাকা দিলে প্রতি পাঁচ জনের জন্য তিনটা খানার টাকা দিবেন। তিনটা খানা পাঁচ জনে ভালভাবে খাওয়া যায়। 

উকূফে আরাফা

আট তারিখ ইশার পর থেকে হাজীদেরকে আরাফায় নেয়া শুরু হয়। সম্ভব হলে আপনি রাতে না গিয়ে ফজরের পর যাবেন। কারণ নবী আলাইহিস সালাম যোহরের আগমুহূর্তে আরাফায় পৌঁছেছিলেন। বাইতুল্লাহর পূর্বদিকে তিন মাইল দূরে মিনা। গাড়ীতে গেলে সময় বেশি লাগে। আর টিনশেড দিয়ে পায়দল গেলে সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট লাগবে। মিনার ময়দান পাঁচ কিলোমিটার বা তিন মাইল। মিনার সাথে লাগানো আনুমানিক দুইশ হাত দূরে বাতনে মুহাসসার। যেখানে হস্তি বাহিনীকে ধ্বং করা হয়েছিল। এরপর থেকে মুযদালিফা শুরু। মুযদালিফাও পাঁচ কিলোমিটার। হাজী বেশি হওয়ার কারণে মুযদালিফার কিছু অংশে তাবু লাগানো আছে। বর্তমানে মিনা মুযদালিফা প্রায় একই সাথে, মাঝখানে কোন ফাঁকা নেই। তবে মুযদালিফা ও আরাফার মাঝে ৫ কিলোমিটার লম্বা একটি খালি ময়দান আছে। সেখানে অনেক টয়লেট বানানো আছে। নিম গাছও আছে। এখানে হজ্জের কোন আমল নেই। এরপর থেকে আরাফা ময়দান শুরু। আরাফা ময়দানও পাঁচ কিলোমিটার। যাই হোক ৯ তারিখ ফযরের পর আরাফা ময়দানে গিয়ে মুয়াল্লিমের তাবুতে যেখানে খালি জায়গা পান অবস্থান করতে থাকেন। যোহরের আগে গোসল ইত্যাদি সেরে আউয়াল ওয়াক্তে আযান ইকামত দিয়ে শুধু যোহর পড়বেন। যারা মসজিদে নামিরায় আমিরুল হজ্জের সাথে নামায পড়বে তারা যোহর আসর একসাথে পড়বে। আপনি মসজিদে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। কাছে মনে হলেও মূলত তা বহু দূর। রোদ্রে বেশি ঘোরাফেরা করলে হিট স্ট্রোক করতে পারেন। (আল্লাহ না করুন, হিট স্ট্রোকের শিকার হলে ঠাণ্ডা পানিতে তোয়ালে বা গামছা ভিজিয়ে পুরো শরীরে চেপে ধরে তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা করুন। এসময় সাধারণত জ্বরের ওষুধে কাজ হয় না।) তো আউয়াল ওয়াক্তে যোহর পড়ে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা যতক্ষণ সম্ভব হয় দাঁড়িয়ে উকূফ করতে থাকুন। নিজ তাঁবুতে অথবা আরাফার ময়দানে প্রচুর নিম গাছ আছে। গাছের ছায়ায় যেখানে ইচ্ছা উকূফ করতে পারেন। উকূফে আরাফা দাঁড়িয়ে শুরু করতে হয়। এরপর প্রয়োজনে বসে বা শুয়ে থাকারও অনুমতি আছে। এখানে আপনাকে মুয়াল্লিমের পক্ষ থেকে সাদাসিধে বিরিয়ানী, ফল এবং জুস দেয়া হবে। তাছাড়া পানি ইত্যাদি সংগ্রহে রাখবেন যাতে প্রচণ্ড গরমে হঠাৎ কোন দুর্ঘটনা না ঘটে। খানা-পিনা খেয়ে হানাফী মাযহাব মতে আসরের ওয়াক্তে আসর পরবেন। ঐ দেশের লোকেরা তিনটার সময় আসরের আযান দেয়, তখন পড়বেন না। বেলা ডোবার এক/দেড় ঘণ্টা আগে পড়বেন। নামায পড়ে যিকির-আযকার, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদিতে মশগুল থাকবেন। বেলা ডোবার পর মাগরিব না পড়ে মুয়াল্লিমের গাড়ীতে উঠে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা হবেন। আরাফা এবং মুযদালিফার মাঝখানে শুধুমাত্র পাঁচ কিলোমিটার লম্বা একটি খালি ময়দান। গাড়ীতে গেলে অনেক সময় পৌঁছতে পৌঁছতে ফজর হয়ে যায়। মাগরিব ইশা একসাথে পড়ার সুযোগ হয় না। তাই যুবকদের জন্য হেঁটে যাওয়াই ভালো। এই খালি ময়দানে এক কিলোমিটার পর পর বিরাট সাইনবোর্ড। উপরে লেখা থাকে মুযদালিফা, আর নিচে লেখা ৪ কি. ৩ কি. ২ কি. ১ কি.। এরপরের সাইনবোর্ডে আরবীতে লেখা থাকে মুযদালিফা শুরু। ইংরেজীতে লেখা থাকে মুযদালিফা স্টার্ট হেয়ার। অনেকে এসব সাইনবোর্ডের নীচের লেখার প্রতি লক্ষ্য না করে উপরে মুযদালিফা লেখা দেখে খালি ময়দানে রাত্রি যাপন করে এবং মাগরিব ইশা একসাথে পড়ে। সকালে যখন সামনে অগ্রসর হয়ে দেখে মুযদালিফা শুরু তখন ভুল ভাঙ্গে। এই জন্য না শিখে গেলে হজ্জ বরবাদ হয়ে যায়। তো পাঁচ কিলোমিটার অতিক্রম করে মুযদালিফায় প্রবেশ করে যেখানেই খালি জায়গা পাবেন অবস্থান করবেন। যদি আপনার মিনার তাঁবু মুযদালিফার অংশে পড়ে তাহলে তাঁবুতে অবস্থান করলেও ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। মুযদালিফায় ইশার ওয়াক্তে এক আযান ও এক ইকামতে মাগরিব ও ইশা পড়বেন। মুযদালিফায় রাত্রি যাপন করা এবং এখান থেকে ছোট ছোট কঙ্কর সংগ্রহ করা সুন্নাত। তারপর ফজর নামায আউয়াল ওয়াক্তে পড়ে বেলা ওঠার পূর্ব পর্যন্ত উকূফ করা ওয়াজিব। তবে মহিলা, বৃদ্ধ এবং শিশুরা সুবহে সাদিকের পূর্বে মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনায় চলে গেলেও উকূফের ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। মহিলাদের প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে কোন পুরুষ থাকলে আল্লাহ তা'আলা তাদেরকেও মাফ করে দিবেন। অন্যদের জন্য সূর্যাস্তের পূর্ব মুহূর্তে মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনায় যেতে হবে। মিনায় গিয়ে বর্তমানে যোহরের পূর্বে কঙ্কর মারতে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। এসময় প্রচণ্ড ভিড় থাকে। অনেকে মারাও যায়। খানা পিনা করে বিকালের দিকে যাওয়া ভাল। প্রথম দিন মিনার শেষ মাথায় জামারা আকাবাতে কঙ্কর মারবেন। মিনার মসজিদে খায়েফের পশ্চিম দিকে সামান্য আগে বাড়লে প্রথমে জামারা সুগরা এরপর জামারা উস্তা এবং সর্বশেষ জামারা আকাবা পড়বে। পাথর মারার জায়গাটা এখন চার পাঁচ তলা বিশিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। দশ তারিখে শুধুমাত্র জামারা আকাবাতে কঙ্কর মারবেন। এদিন প্রথম দু'টিতে মারা জায়েয নেই। সকল হাজী একই দিনে যেহেতু জামারা আকাবাতে কঙ্কর মারবে এজন্য দশ তারিখের সুবহে সাদিক থেকে পরবর্তী সুবহে সাদিক পর্যন্ত চব্বিশ ঘণ্টা সময় রাখা হয়েছে। এর মধ্যে কোন মাকরূহ সময় নেই। খোঁজখবর নিয়ে যখন দেখবেন কোন ধরনের ঝুঁকি বা প্রাণনাশের কোন আশঙ্কা নেই তখন কঙ্কর মারতে যাবেন। দশ তারিখে মারবেন সাতটা। জামারার বেষ্টনীর যথাসম্ভব নিকটে গিয়ে আরবীতে باسم الله الله اكبر رغما للشيطان رضا للرحمن পড়ে অথবা শুধু باسم الله الله اكبر কিংবা বাংলায় ‘শয়তানকে অপদস্ত করার জন্য রহমানকে খুশী করার জন্য কঙ্কর নিক্ষেপ করছি' বলে একটা একটা করে কঙ্কর মারবেন। কঙ্কর যেন পিলারের গোড়ায় পড়ে। খাম্বায় লেগে ফিরে এসে যদি বেষ্টনীর বাইরে পড়ে যায় তাহলে সেটা বাতিল বলে গণ্য হবে। তো দশ তারিখ বড় শয়তানকে মারার পর শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে মক্কায় গিয়ে ফরয তাওয়াফ করুন। গাড়িতেও যাওয়া যায়, টিনশেড দিয়ে হেঁটেও যাওয়া যায়। হেঁটে গেলে আরাম বেশি। ফরয তাওয়াফের সময়টা বার তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত বহাল থাকে। মহিলাদের মাসিক শুরু হয়ে গেলে বার তারিখের পরেও করার অনুমতি আছে। কিন্তু পুরুষ যে কোন কারণে নির্ধারিত সময়ের পরে ফরয তাওয়াফ করলে দম দিতে হবে। ফরয তাওয়াফের সায়ী অগ্রীম না করে থাকলে তাওয়াফের পর সায়ীও করবেন। তাওয়াফ সায়ী করার নিয়ম পূর্বের মতই। কয়েকটা কাজের মধ্যে সিরিয়াল জরুরি। জামারা আকাবাতে কঙ্কর মারা, কুরবানী করা তারপর মাথা মুণ্ডানো। তামাত্তু এবং কিরানকারীদেরও এই কাজগুলোতে সিরিয়াল ঠিক রাখা আবশ্যক।

ব্যাংকের মাধ্যমে কুরবানী করবেন না। অর্ডার বেশি থাকার কারণে তারা সময় ঠিক রাখতে পারে না। সবচেয়ে নিরাপদ হলো, কাফেলার যুবকদের পাঠিয়ে সকলের পক্ষ থেকে কুরবানী করে আসা। মিনার ময়দানের এক থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তর পার্শ্বে তাঁবুর শেষ প্রান্তে মুআইসিম নামক পশুর হাটে এবং মক্কার হালাকা বা নাক্কাসা নামক মার্কেটেও কুরবানী দেয়া যায়। তো বড় শয়তানকে মারার পর যুবকেরা কুরবানী করে মোবাইলে জানিয়ে দিলে মাথা মুণ্ডাতে পারেন। ফরয তাওয়াফের সাথে মাথা মুণ্ডানোর কোন সম্পর্ক নেই। বরং মাথা মুণ্ডাতে হবে জামারা আকাবাতে কঙ্কর মারার এবং কুরবানী হয়ে যাওয়ার পর।

যাই হোক, তাওয়াফ সায়ী করে মিনায় এসে খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিতে থাকেন। দ্বিতীয় দিন কঙ্কর মারার সময় হয় যোহরের ওয়াক্ত হওয়ার পর। এদিন সব জামারায় কঙ্কর মারতে হবে। কঙ্কর মারার সময় ভিড় থেকে বাঁচার উপায় হল- জামারার খাম্বাটা পূর্ব-পশ্চিম লম্বা। খাম্বার ডান বা বাম পাশ দিয়ে ভিড় এড়িয়ে পশ্চিম মাথায় গিয়ে উত্তরমুখী হয়ে দাঁড়ান। কেননা নবীজী কঙ্কর মারার সময় দক্ষিণ সাইডে উত্তরমুখী দাঁড়িয়েছিলেন। এভাবে দাঁড়িয়ে পূর্বের ন্যায় باسم الله الله اكبر رغما للشيطان رضا للرحمن পড়ে প্রথমে জামারা সুগরাতে সাতটি কঙ্কর মেরে সামান্য অগ্রসর হয়ে হাত তুলে দু'আ করুন। একই নিয়মে জামারা উস্তাতেও কঙ্কর মেরে অগ্রসর হয়ে হাত তুলে দু'আ করুন। সর্বশেষ জামারা আকাবাতে কঙ্কর মারার পর দু'আ না করেই চলে যান। দ্বিতীয় দিন তিন জায়গায় সাতটি করে মোট একুশটি কঙ্কর মারা হল। এভাবে তিন দিনে ২১টি করে ৬৩টি এবং প্রথমদিন জামারা আকাবাতে সাতটি মোট ৭০টি কঙ্কর মারা হল। মক্কায় যেহেতু কোন কাজ নেই এজন্য কোন অসুবিধা না থাকলে ১৩ তারিখেও কঙ্কর মারবেন। 

বিদায়ী তাওয়াফ

১৩ তারিখ কঙ্কর মারার পর মক্কায় গিয়ে সাথে সাথে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন না। হজ্জের পূর্বে মদীনায় না গেলে হজ্জের পর আপনাকে মদীনায় নেওয়া হবে। আর মদীনায় যাওয়া হয়ে গেলে এখন দেশে ফেরার পালা। মদীনায় যাওয়া বা দেশে ফেরার তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর মক্কা ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে সাধারণ লেবাসে ইহরাম বাঁধা ছাড়াই শুধুমাত্র বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। সায়ী করতে হবে না। বহিরাগতদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ করা ওয়াজিব। উত্তম হল হজ্জের পর যে কয়দিন মক্কায় অবস্থান করবেন প্রতিদিন কমপক্ষে একটা করে নফল তাওয়াফ করবেন। তাহলে মদীনা বা দেশে ফেরার পূর্বে সময় না পেলে শেষের নফল তাওয়াফটাকে বিদায়ী তাওয়াফ হিসাবে গণ্য করা হবে। এসময় কোন মহিলার মাসিক শুরু হলে তার জন্য বিদায়ী তাওয়াফ মাফ হয়ে যায়। ফরয তাওয়াফ কোন অবস্থাতে মাফ হয় না। মাসিকের কারণে যদি কোন মহিলা ফরয তাওয়াফ করতে না পারে এবং মাসিক চলা অবস্থায় তার মদীনা বা দেশে ফেরার সময় হয়ে যায় তাহলে সে খুব ভালোভাবে কাপড় বেঁধে এ অবস্থায়ই তাওয়াফ করবে। এবং ওযর বশত নাপাক অবস্থায় বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করার কারণে বড় জানোয়ার তথা গরু মহিষ বা উট দ্বারা দম দিতে হবে। ফরয তাওয়াফ ছাড়া দেশে ফিরে আসলে স্বামী স্ত্রীর মাঝে তালাক হবে না কিন্তু একজন অপর জনের জন্য হালাল থাকবে না। টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে দেশে চলে আসতে পারে। অন্য কোন ব্যক্তি দমের জানোয়ার ক্রয় করে হারামে কুরবানী করলে তার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কেননা যে কোন দমের সময় সারাজীবন তবে জায়গা নির্দিষ্ট অর্থাৎ হারাম।

বয়ানের সার সংক্ষেপ 

হজ্জের ফরয তিনটি: ১. ইহরাম বাঁধা। ২. আরাফার ময়দানে উকৃফ করা। ৩. ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে তাওয়াফে যিয়ারত করা।

হজ্জের ওয়াজিব সমূহ: ১. ৯ই যিলহজ্জ সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত মুযদালিফায় অবস্থান করা। ২. ৯ই যিলহজ্জের যোহরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। ৩. মিনায় নির্দিষ্ট দিনগুলোতে কঙ্কর মারা। ৪. কুরবানী করা। ৫. মাথা মুণ্ডানো। মহিলাদের জন্য চুলের আগা থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ কাটা। ৬. হজ্জের সায়ী করা। ৭. মীকাতের বাহির থেকে আগমনকারীদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ করা। হজ্জের ফরযসমূহের কোন একটা ছুটে গেলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে। ওয়াজিব ছুটে গেলে হজ্জ বাতিল হবে না তবে দম দিতে হবে।

সর্বশেষ মদীনা বা দেশে ফেরার সময় তাওয়াফের পর অবশ্যই একটা দু'আ করবেন। আরবীতে পড়তে পারলে ভালো অন্যথায় বাংলায় বলবেন اللهم لا تجعل هذا آخر العهد لبيتك (হে আল্লাহ! এটাই যেন (আমার জন্য) তোমার ঘরের শেষ যিয়ারত না হয়)। বার বার যেন আসার তাওফীক পাই। এই দু'আ পড়ে ব্যথা ভরা দিলে চোখের পানি ফেলে বিদায় নিবেন।

আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে হজ্জে মাবরূর এবং উমরায়ে মুতাকাব্বালা নসীব করুন। আমীন।

পূর্ববর্তী পোষ্ট পরবর্তী পোষ্ট
coinpayu
coinpayu
coinpayu
coinpayu