coinpayu

হজ্জের ফযীলত ও প্রস্তুতি গ্রহণ ২০২৪

 

হজ্জের ফযীলত ও প্রস্তুতি গ্রহণ 

লেখকঃ মুফতী মনসূরুল হক দাঃ বাঃ

হামদ ও সালাতের পর...

মু'আয্যায ও মুহতারাম হুজ্জাজে কেরাম, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে হজ্জে মাবরূর, উমরায়ে মুতাক্বাব্বালা নসীব করুন। আমীন!

আল্লাহওয়ালা হওয়ার সংক্ষিপ্ত ওযীফা 

আমার পীর ও মুরশিদ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক রহ. বলতেন, দুইটি জিনিস আল্লাহর ওলি হওয়ার শর্টকোর্স। একটি রমাযানুল মুবারকের রোযা। কোন ব্যক্তি সতর্কতার সাথে, গুনাহমুক্ত অবস্থায় রমাযানের রোযাসমূহ আদায় করতে পারলে এই এক মাসের মুজাহাদা দ্বারা সে আল্লাহর ওলি হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়টি হজ্জে মাবরূর। গুনাহমুক্ত থেকে, খালেস নিয়তে হজ্জ আদায় করা হলে এই হজ্জের সফর থেকেও বান্দা আল্লাহর ওলি হয়ে ঘরে ফিরে আসতে পারে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, كيوم ولدته أمه যে দিন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছিল সে দিনের মত নিষ্পাপ বানিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৫২১)

এমনকি হাজী সাহেবদের ইস্তিকবাল করতে, ঘরে প্রবেশের পূর্বে তাদের সাথে সাক্ষাত করতে, সালাম দিয়ে মুসাফাহা করতে এবং তাদের নিকট ইস্তিগফারের দরখাস্ত করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, হজ্জের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা হাজীদেরকে মাফ করে দেন এবং তারা যাদের জন্য ইস্তিগফার করেন তাদেরকেও মাফ করে দেন। (শু‘আবুল ঈমান; হা.নং ৩৮১৭)

মাওলার ঘরে মাওলার আশেক 

এমন মুবারক সফরের তাওফীক পাওয়া আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের খাস ইশক ও মহব্বতের আলামত। এ সফরে কোন কোন যাত্রী সত্যিকারেই আল্লাহ তা'আলার পাগল থাকে। কিন্তু দুনিয়াতে তো আল্লাহ তা'আলাকে চর্মচক্ষু দ্বারা দেখা যায় না। তাই আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করে সান্ত্বনা লাভ করে। দুনিয়ার সমস্ত মসজিদ বাইতুল্লাহ; বাংলায় আমরা বলি আল্লাহর ঘর। কিন্তু শরীয়তে সব মসজিদকে বাইতুল্লাহ নামে নামকরণ করা হয়নি। শুধু একটি ঘরকে বাইতুল্লাহ বলা হয়েছে। ‘আল্লাহর ঘর’ এর অর্থ এই না যে আল্লাহ তা'আলা সেখানে অবস্থান করেন; নাউযুবিল্লাহ। আল্লাহ তা'আলার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এ ঘরের সম্মান বৃদ্ধির জন্য, খায়ের ও বরকত বুঝানোর জন্য। হাজী সাহেবগণ আল্লাহর ইশক ও মহব্বতে এ ঘর প্রদক্ষিণ করেন, যেমন মজনু লায়লার শহর প্রদক্ষিণ করত। লায়লা- মজনুর কাহিনী কোন অবাস্তব কিচ্ছা নয়। তিনি তাবেয়ী ছিলেন। তার প্রকৃত নাম কায়েস ইবনে মালূফ। হযরত উমর ফারূক রাযি. এর সাথে তার সাক্ষাত হয়েছিল। দুনিয়াতে একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টির জন্য আল্লাহ তা'আলা মজনুর দিলে লায়লার মহব্বত পয়দা করে দিয়েছিলেন। এ মহব্বতের কারণে তাদের মাঝে আধুনিক প্রেম-প্রীতির ন্যায় কোন নোংরামী সংগঠিত হয়নি। লায়লার মহব্বত মজনুর দিলে ছিল; তবে পরস্পরের মধ্যে কোন দিন দেখা- সাক্ষাত হয়নি। মজনু লায়লার শহরে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন কবিতা আবৃত্তি করত। কুতবুল আলম শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. ফাযায়েলে তাবলীগের মধ্যে মজনুর কিছু কবিতা উল্লেখ করেছেন-


امر علي الديار ديار ليلي 

أقبل ذا الجدار وذا الجدار

وما حب الديار شغفن قلبي 

ولكن حب من سكن الديار

অর্থ : আমি যখন লায়লার শহরের উপর দিয়ে যাই, তখন আমি এ দেয়াল সে দেয়াল চুম্বন করতে থাকি। বস্তুত শহরের ঘরবাড়ী আমাকে পাগল করেনি; বরং আমাকে পাগল করেছে এই শহরের অধিবাসিনীর মহব্বত।

ইশক ও মহব্বতের পর্যায়ক্রমিক স্তর

মজনু লায়লার মহব্বতের সর্বশেষ স্তরে পৌছার পর লায়লার শহরে গিয়ে অলি- গলিতে ঘোরাফেরা করত। ঠিক তদ্রূপ দুনিয়াতে ঈমানের দ্বারা, কালিমার দ্বারা বান্দা আল্লাহর মহব্বতের প্রথম স্তর হাসিল করে। তখন বার বার আল্লাহর নাম নিতে মনে চায়। এজন্য দ্বিতীয় স্তরে নামায, যিকির, কুরআন তিলাওয়াত রাখা হয়েছে। অতঃপর মহব্বত যখন আরো গভীর হয় তখন খানাপিনা ভালো লাগে না; আল্লাহর মহব্বতে মন ক্ষুধার্ত থাকতে চায়। এজন্য রোযার বিধান দেয়া হয়েছে। এ বিধান পেয়ে আল্লাহর আশেকগণ শুধু রমাযানের রোযা রেখে ক্ষান্ত হয় না; প্রত্যেক মাসে আইয়্যামে বীয এবং সাপ্তাহিক রোযারও ইহতিমাম করে। এর পর নিজের সমস্ত প্রিয় বস্তু, ধন সম্পদ প্রিয়তমের নামে উৎসর্গ করার স্পৃহা জাগে। তাই আল্লাহ তা'আলা যাকাত, দান-খয়রাতের ব্যবস্থা রেখেছেন। এভাবে মহব্বতের একেক স্তর পার হওয়ার পর এক সময় আল্লাহ পাকের দর্শন লাভের জন্য বান্দা অস্থির হয়ে ওঠে। বান্দার এ আকাঙ্ক্ষা পুরণ করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হজ ও উমরার নির্দেশ দান করেছেন ।

আল্লাহ তা'আলার দীদার প্রসঙ্গ 

দুনিয়াতে স্বচক্ষে আল্লাহ তা'আলার দীদার অসম্ভব। অনেক ভণ্ডপীর মুরীদদেরকে আল্লাহর দর্শন লাভের ওয়াদা করে। এ ধরনের কথা বলা কুফরী। যেখানে হযরত মূসা আ. এর মত শীর্ষস্থানীয় নবীর পক্ষেও আল্লাহ তা'আলাকে দেখা সম্ভব হল না সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা কিভাবে সম্ভব? আল্লাহ পাকের দীদার জান্নাতের সবচেয়ে বড় নেয়ামত। তখন এমন চক্ষু দান করা হবে যা আল্লাহ তা'আলার দর্শন বরদাশত করতে সক্ষম হবে, দুনিয়াতে যা মানুষের চক্ষু বরদাশত করতে অক্ষম। আল্লাহ তা'আলা তূর পাহাড়ে স্বীয় নূরের সামান্য তাজাল্লী প্রকাশ করেছিলেন। যার ফলে পাহাড় টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল এবং হযরত মূসা আ. এর সাথে পাহাড়ে গমনকারী ৭০ জন মানুষ বেহুশ হয়ে গিয়েছিল। হযরত মূসা আ. আল্লাহর দরবারে দুআ' করলেন, হে আল্লাহ! এ লোকগুলো যদি মারা যায় তাহলে আমি কওমের নিকট কী জবাব দিব? অতএব আপনি আমাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জানগুলোকে ফিরিয়ে দিন। যেখানে সামান্য নূরের তাজাল্লীর কারণে পাহাড় টুকরা হল, শক্তিশালী ৭০ জন মানুষ বেহুশ হল সেখানে বর্তমান যুগের মানুষের পক্ষে আল্লাহর দীদার লাভ করা কিভাবে সম্ভব? এ ছাড়াও আয়াত ও হাদীস দ্বারা বোঝা যায় দুনিয়াতে আল্লাহ পাকের দর্শন লাভ অসম্ভব। হাদীসে পাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আল্লাহ তা'আলার দীদার লাভের যে বর্ণনা এসেছে তা স্বচক্ষে নয়; স্বপ্নে ছিল। (সুনানে দারেমী : হা. নং ২১৯৫)

মোটকথা, কোন কোন হাজী সাহেব সত্যিকারেই আল্লাহর পাগল থাকেন। আর কিছু হাজী সাহেব পাগলের বেশ ধারণ করেন। তখন আসলের সাথে মিলিয়ে নকল পাগলদেরকেও আল্লাহ তা'আলা আরাফাতের ময়দানে মাফ করে দিয়ে আপন ওলি বানিয়ে নেন । এদিন শয়তান সব থেকে বেশি লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, মুনাজাতের মধ্যে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করো, কান্না না আসলে কান্নার ভান করো। (সহীহ মুসলিম; হা. নং ১৩৪৮, মুআত্তা মালেক হা. নং ১৫৯৭)

ইসলাম: যুক্তিতে নয়; মহব্বতে 

হাজী সাহেবগণ আল্লাহ তা'আলার মেহমান। আল্লাহ তা'আলার মেহমানদারীর স্থান ৮ তারিখে মিনায়, ৯ তারিখ রাতে মুযদালিফায় এবং ১০ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত পুনরায় মিনায়। মেহমানদারীর অর্থ হল আল্লাহ তা'আলার খাস রহমত। নবীজী ৮ তারিখের যোহর মিনার ময়দানে আদায় করেছিলেন। রাসূলের আশেকগণও ৮ তারিখে মিনায় অবস্থান করছেন। এমন যুক্তি দেখাবেন না যে, বাইতুল্লায় এক রাকা'আতে এক লক্ষ রাকা'আতের সওয়াব পাওয়া যায়; মিনায় এক লক্ষ রাকা'আতের ব্যাপারে তো হাদীস নেই; তাহলে যোহর মিনায় পড়ব কেন? আপনি যদি রাসূলের মহব্বতে আল্লাহ তা'আলার মেহমানদারী গ্রহণ করার জন্য ৮ তারিখে মিনায় চলে আসেন তাহলে এক রাকা'আতে আল্লাহ কত লাখ রাকা'আতের সওয়াব দিবেন সেটা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, এক লাখ থেকে অনেকগুণ বেশি দিবেন। কোন হাজী সাহেব এক লক্ষ রাকা'আতের সওয়াব পাওয়ার জন্য ৮ তারিখে মিনায় না গিয়ে বাইতুল্লা'য় থেকে গেলে এক রাকা'আতে এক রাকা'আতেরই সওয়াব পাবে; বেশি পাবে না। কারণ বাইতুল্লাহর নিজস্ব কোন ফযীলত নেই। সমস্ত ফযীলত আল্লাহ পাকের হুকুমের কারণে। হাজী সাহেবদের জন্য এক রাকাআতে এক লক্ষ রাকা'আতের সওয়াব আল্লাহ তা'আলা ৮ তারিখে বাইতুল্লা'য় বহাল রাখেননি। এ সওয়াব সেদিন আরো বাড়িয়ে মিনার ময়দানে বহুগুণ বাড়িয়ে রেখেছেন। মোটকথা, যেদিন যে স্থানে আল্লাহর মেহমানদারী সেদিন সেখানেই থাকতে হবে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১০ তারিখে বাইতুল্লায় গিয়েছিলেন ফরয তাওয়াফ করতে। তাওয়াফ করে সাফা-মারওয়া সায়ী করে বাইতুল্লা'য় যোহর না পড়ে মিনায় এসে পড়েছেন। এক রাকা'আতে এক লক্ষ রাকা'আতের সওয়াবের জন্য বাইতুল্লা'য় থেকে যাননি। কেননা ১০ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত আল্লাহর মেহমানদারী মিনার ময়দানে। এর দ্বারা বোঝা যায়, যুক্তির নাম ইসলাম নয়। আল্লাহর হুকুম এবং রাসূলের তরীকা মানার নাম হল ইসলাম।

পাগলের বেশধারণ

আল্লাহর মহব্বতের শেষ মারহালায় পৌঁছে মানুষ হয়ত সত্যিকার আল্লাহর পাগল হয়ে যায়। অথবা পাগলের অনুকরণ করে, বেশ-ভূষা ধারণ করে। হজ্জের লেবাসও পাগলের লেবাসের মত। রাজা-প্রজা, প্রধানমন্ত্রী-জনগণ সকলকেই এ পোশাক পরিধান করতে হয়। মাথা খোলা রেখে একটা চাদর শরীরে আরেকটা চাদর পরনে এ অবস্থায় কখনো আরাফার মাঠে, কখনো মুজদালিফার বালুর মধ্যে পাগলের মত পড়ে থাকতে হয়। সত্যিকার আল্লাহর পাগলেরা এর মধ্যেই জান্নাতী স্বাদ অনুভব করে। কাফের মুশরিকরা হাজী সাহেবদের কাজকর্মকে অনর্থক মনে করে কোটিপতি হয়েও সাদা চাদর পরিধান করে বালুর মধ্যে শুয়ে থাকার, উযূ ইস্তিঞ্জার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর রহস্য তাদের বুঝে আসে না। তখন মুসলমানদের নিয়ে তারা হাসি তামাশা করে। এ কারণে হজ্জের চিত্র টিভি ইত্যাদিতে প্রচার করা নিষেধ। হজ্জের সবকিছু আশেক-মাশুকের মধ্যকার ভেদ; যা গোপন রাখতে হয়। কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ শরীয়ত গর্হিত কাজে লিপ্ত হই, হজ্বের বিভিন্ন ছবি উঠিয়ে রাখি, ভিডিও করে রাখি। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, যে প্রাণীর ছবি তৈরি করে আল্লাহ তা'আলা তাকে কিয়ামতের ময়দানে কঠিন শাস্তি দিবেন। (সহীহ বুখারী; হা. নং ২২২৫) 

সাদা ইহরামের সাদামাটা বার্তা

ইহরামের সাদা কাপড় মাইয়িতের কাপন সদৃশ। এ কাপড় মউতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যত বড় লাখপতি, কোটিপতি, মিল-ফ্যাক্টরির মালিক হোক, ইহরামের কাপড়ের মত দু‘টুকরো সাদা চাদরই হবে তার আখেরী লেবাস: দুনিয়া থেকে আর কিছুই কবরে তার সাথে যাবে না। যে সারা দিন সম্পদের চিন্তায় মগ্ন, মিল ফ্যাক্টরি তৈরীর ফিকিরে বিভোর সে বড় ধোঁকার মধ্যে আছে, এ সম্পদ সে অন্যের জন্য জমা করছে, যা তার বিবি বাচ্চারা ভোগ করবে। তার প্রকৃত মাল হল শুধুমাত্র দু'টি চাদর আর যা সে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছে। অনেক বেওকুফ অন্যের দুনিয়া সাজাতে গিয়ে নামায তরক করে, হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে সম্পদ উপার্জন করে নিজের আখেরাত বরবাদ করছে। বর্তমান মুসলমানগণ আল্লাহ তা'আলার থিউরী গ্রহণ না করে কারূনের থিউরী গ্রহণ করছে। কারূনের থিউরী হল, হালাল-হারামের বাছ বিচার না করে মাল জমা করা। আর আল্লাহ তা'আলার থিউরী হল, আমি দিতে থাকব তোমরা দীনের পথে ব্যয় করতে থাকবে। আমার খাজানায় শর্ট পড়ার ভয় করো না কেননা সারা দুনিয়ার মানুষের চাহিদা মিটিয়ে দিলেও আমার খাজানা খালি হবে না। (সহীহ মুসলিম; হা. নং ২৫৭৭) 

আত্মশুদ্ধি না থাকায় আমাদের দিল সম্পদের মহব্বতে ভরপুর, কথা কাজে মিল নেই, ওয়াদা খেলাফী করি, ওজনে কম দেই, ‘মেড ইন বাংলাদেশে' ‘মেড ইন জাপানে'র সিল মেরে অর্থ উপার্জন করি। সর্বোপরি অন্যের দুনিয়ার জন্য নিজের আখেরাত বরবাদ করছি। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে হেফাযত করুন। আমীন।

নবীজী একদিন সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে নিজের চেয়ে অন্যের মাল বেশি হেফাযত করে? সাহাবায়ে কেরাম রাখি জবাব দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের কেউ এমন নয়। নবীজী বললেন, তোমরা সবাই এমন কর; কেননা সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে যে মাল তোমরা উপার্জন করছ এসবের মালিক তো তোমাদের বিবি বাচ্চারা। তোমরা শুধু এতটুকুর মালিক যতটুকু তোমরা দান খয়রাত করে পরকালের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছ। (সহীহ মুসলিম; হা. নং ২৯৫৪) 

অন্তরকে মালের মহব্বত থেকে পবিত্র করার জন্য কোন হক্কানী আল্লাহওয়ালার সোহবত গ্রহণ করতে হবে। যে সাপের মন্ত্র জানে সে সাপখেলা দেখিয়ে অর্থোপার্জন করার সময় তার প্রাণভয় থাকে না। তদ্রূপ যে ব্যক্তি কোন আল্লাহওয়ালার সোহবতে থেকে দিলকে মালের মহব্বত থেকে পরিশুদ্ধ করতে পেরেছে মাল নামক বিষধর সাপ তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। বরং এ মাল তার জন্য রহমত হয়। সে সম্পদ ব্যবহার করে দীনের দাওয়াত নিয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, হজ্জ উমরা পালন করে, মসজিদ মাদরাসা তৈরী করে; সবগুলো কাজই মুবারক আর মুবারক। পক্ষান্তরে মালের মহব্বত যদি দিল থেকে বের না হয় তাহলে মালের দংশনে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রত্যেকটা টাকার হিসাব দিতে হবে; কিভাবে উপার্জন করেছ? হালাল পন্থায় না কি হারাম পন্থায়? কোথায় খরচ করেছ? গরীবের কষ্টের সময়, মসজিদ মাদরাসার প্রয়োজনের সময় মাল খরচ করেছিলে না কি কারূনের মত জমিয়েছিলে? কোন কোটিপতি পর্যন্ত একটা টাকা অনর্থক খরচ করার অধিকার রাখে না। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, তোমরা স্বীয় সম্পদ অনর্থক ব্যয় করো না; আল্লাহ তা'আলা সম্পদ দান করেছেন এর দ্বারা আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য; অনর্থক খরচ করার জন্য নয়। হাদীস শরীফেও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পদ নষ্ট করতে নিষেধ করেছেন। (শু'আবুল ঈমান; হা. নং ৬১২৫)

হজ্জের প্রস্তুতির জন্য দু'আ 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি আমল ছিল রমাযানুল মুবারকের জন্য দুই মাস আগে থেকে তিনি দু'আ জারি রাখতেন। জীবনে একটা রমাযান পাওয়া মানে আল্লাহ তা'আলার প্রভূত নৈকট্য লাভ করা। রমাযানের সমস্ত ইবাদাত বন্দেগী কবুল হওয়ার জন্য দু'আ করতে হবে। আর আমরা যারা হজ্জের নিয়ত করেছি আমাদেরও দু'আ চালু রাখতে হবে, আল্লাহ তা'আলা যেন আমাদেরকে হজ্জ সম্পন্ন করার তাওফীক দান করেন। মক্কায় পৌঁছার পর এক জনকে দেখেছি নাস্তা করে উমরা করতে যাবে, হঠাৎ হার্ট এটাক করে মারা গেছে।

শুধুমাত্র হজ্জের নিয়ত করার দ্বারাও সওয়াব পাওয়া যায় তবে হজ্জ সম্পন্ন করার ভিন্ন একটা বরকত আছে। মূলত সওয়াব দুই প্রকার। এক হল কানূনী বা আইন মোতাবেক সওয়াব। আরেক হল ইন'আমী বা পুরস্কারের সওয়াব। কানূনী সওয়াব হজ্জের নিয়ত করলেই পাওয়া যায়। কিন্তু হজ্জ সম্পন্ন করলে কানূনী সওয়াবের সাথে সাথে ইন'আমী সওয়াবও পাওয়া যাবে। ইন' আমী সওয়াবের পরিমাণ আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। তিনবার সূরা ইখলাস পাঠ করলে এক খতম কুরআন তিলাওয়াতের কানূনী সওয়াব পাওয়া যায়। কিন্তু যদি আল্লাহর কোন বান্দা পূর্ণ এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করে তাহলে সে কানূনী বা আইন মোতাবেক সওয়াবের সাথে সাথে ইন'আমী বা পুরস্কারের সওয়াবও পাবে। কানূনী সওয়াবের সাথে ইন'আমী সওয়াব পাওয়ার জন্য দু'আ জারি রাখতে হবে। আল্লাহ তা'আলা যেন আমাদেরকে সত্যিকারার্থে আল্লাহর আশেক হয়ে সরেজমিনে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করার, মিনা, মুযদালিফা এবং আরাফার ময়দানে আল্লাহর মেহমানদারী গ্রহণ করার তাওফীক দান করেন। আমীন

হজ্জের পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের গুরুত্ব 

অনেক হক্কানী উলামায়ে কেরাম হজ্জের ট্রেনিং দিয়ে থাকেন, হজ্জের উপর বিভিন্ন কিতাবাদিও রচনা করেন সেগুলো সংগ্রহ করে পড়াশুনা করতে থাকি এবং খোঁজ খবর নিয়ে হজ্জের ট্রেনিংয়েও শরীক হই। আলহামদুলিল্লাহ জামি'আ রাহমানিয়ায় প্রতি বছর শাওয়ালে হজ্জের প্রথম ফ্লাইট হওয়ার পূর্বে শুরু ব্ল্যাকবোর্ডের সাহায্যে হাতে কলমে হজ্জের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। আগে থেকে তারিখ জেনে নিয়ে নিজে এবং বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে যারা হজ্জে যাচ্ছে তাদেরকে নিয়ে যেতে পারি। বহু বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আল্লাহ তা'আলা আমাকেও হজ্জের উপর কিতাব লেখার তাওফীক দিয়েছেন; যা সুবিধার জন্য পকেট সাইজ বড় সাইজ উভয় সাইজে ছাপা হয়েছে। হজ্জের সফরে এ কিতাবটিও সাথে রাখলে আশা করি ফায়েদা হবে।

হজ্জ এমন একটা আমল যে, সেখানে গেলে বড় বড় আলেমগণও মাসআলা ভুলে যান। মোল্লা আলী কারী রহ. গুনইয়াতুন্নাসিক নামে হজ্জের উপর সবচে' নির্ভরযোগ্য কিতাব লিখেছেন। তিনি একবার মাসআলা ভুলে গিয়েছিলেন। মাসআলাটি হল, মক্কার বহিরাগতদের জন্য সর্বপ্রথম কাজ হল বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করা। আমরা যেমন মসজিদে প্রবেশ করে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ি, হারামে তাহাইয়্যাতুল মসজিদ হল তাওয়াফ করা। মোল্লা আলী কারী রহ. তাওয়াফ না করে তাহিইয়্যাতুল মসজিদ পড়তে আরম্ভ করে দিলেন। এক গ্রাম্য লোক এসে ধমক দিয়ে বললেন, তাহিইয়্যাতুল মসজিদ পড়ছেন কেন? বহিরাগতদের জন্য বাইতুল্লা'য় প্রথম কাজ তো হল তাওয়াফ করা। আপনি কি মানাসিকে মোল্লা আলী কারী পড়ে আসেননি? মোটকথা, দুনিয়ার কাজ এদিক সেদিক করে হলেও হজ্জের ট্রেনিংয়ে শরীক হওয়ার চেষ্টা করবেন।

আল্লাহর ঘরে দুনিয়ার দাওয়াত 

আরেকটি জরুরী বিষয় হল, হজ্জে যাওয়ার পূর্বে আল্লাহর রাস্তায় কিছু সময় লাগিয়ে যাওয়ার ফিকির করবেন, আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। বাইতুল্লাহর চতুর্দিকে দুনিয়া বিছিয়ে রাখা হয়েছে। বাইতুল্লা'য় আসা-যাওয়ার পথে দুনিয়া আপনাকে দাওয়াত দিতে থাকবে। আল্লাহর রাস্তায় কিছু সময় লাগিয়ে গেলে দুনিয়া আপনাকে ধোঁকায় ফেলতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। নিরিবিলি ইবাদত বন্দেগীতে মাশগুল থাকবেন। বাইতুল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকাও ইবাদাত। বারবার উমরা করার চেয়ে বেশি বেশি নফল তাওয়াফ করার সওয়াব বেশি। যখন চলে আসার ২/৪ দিন বাকী থাকে তখন সুন্নাত হিসাবে বিবি বাচ্চাদের জন্য কিছু কাজের জিনিস, যেমন জায়নামায, তাসবীহ,আতর ইত্যাদি ক্রয় করতে পারেন। শুরুতেই কেনাকাটা করা বোকামি। এতে এগুলো পাহারা দেয়া, মক্কা মদিনায় টানাটানি করা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পেরেশানী ভোগ করতে হয়।

মাকবুল হজ্জের শর্ত 

আখেরী কথা হল, হজ্জে মাবরূর বা মাকবূল হজ্জের জন্য চারটি শর্ত। প্রথম শর্ত : বান্দার হক আদায় করে যাওয়া। পিতার ইন্তিকালের পর যারা বোনদেরকে পৈতৃক সম্পত্তি বণ্টন করে দেননি অবশ্যই তাদের হক বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন। কাউকে গালি দিয়ে থাকলে তার কাছেও মাফ চেয়ে নিবেন। মৃত্যুর পূর্বে যেমন সবার কাছে মাফ চাওয়া হয় তেমনি হজ্জে যাওয়ার পূর্বেও সকলের থেকে মাফ চেয়ে নিবেন।

দ্বিতীয় শর্ত : নিয়তকে খালেস করা। অর্থাৎ আল্লাহর ইশক মহব্বতের জন্য যাওয়া; দুনিয়াবী কোন গরজ না রাখা। নফস আপনার সামনে অনেক কিছু পেশ করবে যে, তোমাকে আলহাজ বলা হবে, মসজিদ মাদরাসার সভাপতি বানানো হবে ইত্যাদি। নফস যতবার ধোঁকা দিবে ততবার প্রতিহত করবেন। নতুন করে আল্লাহর রেযামন্দির নিয়ত করবেন। তাহলে আপনাকে ক্ষতি করতে পারবে না। দিলে এসব ধারণা আসা রিয়া নয়; এটাকে বলা হয় ওয়াসওয়াসায়ে রিয়া। নিয়ত গলত থাকলেও পুনরায় সহীহ করা যায়। শরীয়ত এত কঠিন না যে, নিয়ত একবার গলত হয়ে গেলে আর কখনো শুদ্ধ করা যাবে না। শরীয়ত জানা থাকলে সবকিছু সহজ।

তৃতীয় শর্ত : হজ্জের সফরে ইচ্ছাকৃত কোন গুনাহ না করা। অনেক মহিলা পর্দা করার তরীকা জানা না থাকার কারণে মুখ খোলা রাখে। আমাদের দেশের ক্যাপের মত কপালে কিছু বেঁধে তার উপর দিয়ে পর্দা ঝুলিয়ে দিতে হয়। এতটুকু না জানার কারণে মহিলারা মুখ খোলা রাখে। আর কিছু ভাই সারাদিন ইরানী গোলাপ, মালোশিয়ান চামেলী দেখতে থাকে। কত বড় গুনাহের কাজ! আরেকটি গুনাহ হল, বিভিন্ন হোটেলে টেলিভিশন চলে আর অনেক হাজী সাহেব বসে বসে দেশের খবর নিতে থাকে। দেশের খবর নিতে গিয়ে নিজের হজ্জ নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবর থাকে না। মানুষকে গুনাহের দৃশ্য দেখা না দেখার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। চোখের উপর পর্দা রয়েছে; গুনাহের মুহূর্তে বন্ধ করা যায়। গুনাহের জিনিস দেখলেই চক্ষু বন্ধ করে দিবেন। আর বর্তমানে মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তোলা তো ব্যাপক হয়ে গেছে। স্বামী স্ত্রীর স্ত্রী স্বামীর ছবি তোলে। ইয়াহুদীরা প্রত্যেক মুসলমানকে ফটোগ্রাফার বানিয়ে দিয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি কোন জানদারের ছবি উঠায় হাশরের মাঠ তাকে ঐ ছবিতে জান দিতে বলা হবে; অন্যথায় কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ২২২৫ ) ক্যামেরা বিশিষ্ট মোবাইল ব্যবহার করবেন না। যদি করতেই হয় তাহলে ক্যামেরার উপর পট্টি লাগিয়ে দিবেন যাতে গুনাহের সুযোগই না থাকে।

চতুর্থ শর্ত : হজ্জ থেকে ফেরার পর আমাদের যিন্দেগী যেন আগের থেকে বেশি আখেরাতমুখী হয়। ব্যবসা- বাণিজ্য, কাজ-কারবার যেন দীন থেকে গাফেল করতে না পারে। দিল যেন থাকে আল্লাহর হুকুমের দিকে, মসজিদ মাদরাসার দিকে, হক্কানী উলামায়ে কেরামের মজলিসের দিকে। আমাদের দিল মুর্দা হয়ে গেছে; উলামায়ে কেরামের মজলিসে যেতে চায় না। অথচ কিতাবে এসেছে, বাচ্চা ভূমিষ্ট হওয়ার পর ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামত দাও; তারপর মায়ের দুধ পান করাও। এর দ্বারা বোঝা গেল, বাচ্চার শারীরিক খোরাকের চেয়ে রূহানী খোরাকের প্রয়োজন বেশি। কিন্তু আমরা রূহানী খোরাক আল্লাহওয়ালাদের সোহবত থেকে একেবারেই মাহরূম। বছরে একবারও যাওয়ার সুযোগ হয় না। এমতাবস্থায় আমাদের দীনদারী কিভাবে উন্নত হবে? সীরাতে মুস্তাকীমের উপর কিভাবে কায়েম থাকব? এমন হলে যে কোন সময় শয়তান ধোঁকায় ফেলতে পারে। আল্লাহ হিফাযত করুন। হজ্জে মাবরূরের মোটামুটি চারটা শর্ত বলা হল। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে হজ্জে মাবরূর নসীব করুন। আমীন। 


[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত]

পূর্ববর্তী পোষ্ট পরবর্তী পোষ্ট
coinpayu
coinpayu
coinpayu
coinpayu