হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. এর জীবনী ২০২৪
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.
ত্ববকা (রিজাল শাস্ত্রে রাবীর অবস্থান): সাহাবী
হযরত আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাতো ভাই। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা হযরত আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র।
তাঁর উপনাম আবুল আব্বাস। তিনি ছিলেন একজন সুদর্শন, বিশালকায়, সুঠামদেহী, রাশভারী, প্রখর বুদ্ধিমান এবং একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তিনি এতই রূপবান ছিলেন যে, পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্য 'আতা রহ. বলতেন- আমি যখনই পূর্ণিমার চাঁদ দেখি, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি.-এর চেহারা স্মরণ হয়ে যায়।
তাঁর মায়ের নাম উম্মুল ফযল লুবাবা বিনতুল হারিছ, যিনি ছিলেন উম্মুল মু'মিনীন হযরত মায়মুনা রাযি.-এর বোন। তিনি হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ রাযি.-এর খালাতো ভাই ছিলেন। হিজরতের তিন বছর পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশব থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। বোনপুত্র হওয়ার কারণে উম্মুল মু'মিনীন হযরত মায়মুনা রাযি.-এর ঘরে তিনি খুব আসা-যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সুযোগে তিনি প্রাণভরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করারও সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। তাঁর খেদমতে খুশি হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন এবং নিজ মুখের পবিত্র লালা তাঁর মুখে লাগিয়ে দিয়ে দু'আ করেছিলেন, হে আল্লাহ! তাকে দীনের গভীর বুঝ দান করুন এবং কুরআনের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিন।
একবার শেষরাতে তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে টেনে নিয়ে নিজের পাশে দাঁড় করান। নামায শেষে তিনি আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আল্লাহর রাসূল। কারও কি আপনার বরাবর পাশে দাঁড়িয়ে নামায পড়া উচিত? তাঁর এ বুদ্ধিদীপ্ত কথায় খুশি হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু'আ করেছিলেন- আল্লাহ তা'আলা যেন তার দীনের বুঝ ও 'ইলম আরও বৃদ্ধি করে দেন। তাঁর এ দু'আ কবুল হয়েছিল। ফলে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে তিনি একজন বিশিষ্ট ফকীহ এবং কুরআন মাজীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য পেয়েছিলেন মাত্র ৩৩ মাস। হিজরতের পর যখন মদীনা মুনাওয়ারায় আগমন করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। এর দু' বছরের মাথায়ই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত হয়ে যায়। এই অল্প সময়ের মধ্যে বালক আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিপুল পরিমাণ ইলম আহরণ করেছিলেন। তাঁর জ্ঞান আহরণের পিপাসা ছিল প্রচণ্ড। পরে তিনি হযরত উমর রাযি. হযরত আলী রাযি. হযরত মু'আয রাযি. হযরত আব্দুর রহমান ইবন 'আওফ রাযি.-সহ শীর্ষস্থানীয় ও সুবিজ্ঞ সাহাবায়ে কিরামের কাছ থেকেও 'ইলম হাসিল করতে থাকেন। তাছাড়া অন্যান্য মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে 'ইলমের অনুসন্ধান অব্যাহত রাখেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বর্ণনা করেন, আমি জনৈক আনসারী ব্যক্তিকে বললাম, চল আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের কাছে যাই এবং তাদের কাছে দীন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। এখন তো তারা প্রচুর সংখ্যক আছেন। ওই লোক বলল, ওহে ইবন 'আব্বাস! বড় আশ্চর্য কথা! তুমি কি মনে কর লোকে তোমার কাছে আসার প্রয়োজন বোধ করবে, যখন তাদের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ আছেন, যাদের তুমি দেখতে পাচ্ছ? যাহোক সে ব্যক্তি আমার কথা শুনল না, কিন্তু আমি সাহাবীদের কাছে গিয়ে গিয়ে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করতে থাকলাম। কখনও এমন হত যে, কোনও সাহাবী সম্পর্কে জানতাম যে, তাঁর কোনও হাদীছ জানা আছে, আমি তাঁর কাছে চলে যেতাম। তিনি হয়তো তখন বিশ্রামে থাকতেন। আমি তাঁর দরজায় চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়তাম আর তখন বাতাসে উড়ন্ত ধুলায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে যেতাম। এ অবস্থায় সেই সাহাবী বের হয়ে এসে আমাকে দেখতেন আর বলে উঠতেন, ওহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাতো ভাই! আপনি আমাকে খবর দিলেন না কেন, আমিই আপনার কাছে চলে যেতাম? আমি বলতাম, না, আমারই কর্তব্য আপনার কাছে আসা এবং দীন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা।
এভাবেই আমার চলতে থাকল। একপর্যায়ে আমার কাছে লোকের ভিড় জমতে থাকল আর তা দেখে ওই আনসারী ব্যক্তি মন্তব্য করল, এই যুবক আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।
হযরত ইবন আব্বাস রাযি. বলেন, কখনও এমনও হয়েছে যে, একেকটা বিষয় আমি ৩০ জন সাহাবীকে জিজ্ঞেস করেছি।
এই প্রচণ্ড জ্ঞানতৃষ্ণারই ফল যে, একপর্যায়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও ফকীহরূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। হযরত উমর রাযি. তাঁর সম্পর্কে বলতেন, সে এক পৌঁঢ় যুবক। তার আছে জিজ্ঞাসু রসনা এবং সমঝদার অন্তঃকরণ। তিনি একদিন তাকে লক্ষ করে বলেন, তুমি এমন ইলম শিখেছ, যা আমরা শিখিনি।
তাঁর জ্ঞানবত্তার কারণে হযরত উমর রাযি, তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এমনকি তিনি তাকে প্রবীণ সাহাবীদের সঙ্গে নিজে পরামর্শসভার সদস্য করে নিয়েছিলেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. তাঁর সম্পর্কে বলতেন, সে যদি আমাদের বয়স পেত তবে আমাদের কেউ তার সমপর্যায়ে পৌঁছতে পারত না। তিনি আরও বলতেন, ইবন আব্বাস বড় উত্তম কুরআন ব্যাখ্যাতা।
তাঁর শিষ্য ইকরিমা রহ. বলেন, আমি হযরত মু'আবিয়া রাযি.-কে বলতে শুনেছি,আল্লাহর কসম! যারা মারা গেছে এবং যারা জীবিত আছে, ইবন 'আব্বাস তাদের সকলের চেয়ে বড় ফকীহ।
আবূ ওয়াইল রহ. বলেন, এক হচ্ছে ইবন আব্বাস রাযি. আমাদের আমীর ছিলেন। তখন তিনি আমাদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে সূরা নূরের ব্যাখ্যা শুরু করেন। তাঁর সারগর্ভ ব্যাখ্যা শুনে আমি মনে মনে বলছিলাম, আমি এমন ভাষণ দিতে কাউকে দেখিওনি, শুনিওনি। পারস্য, রোম ও তুর্কের লোক যদি তাঁর এ ভাষণ শুনত, তবে তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করত।
মাসরূক রহ. বলেন, আমি যখন ইবন আব্বাস রাযি.-কে দেখতাম তখন বলতাম, ইনি শ্রেষ্ঠতম রূপবান। যখন তাঁর কথা শুনতাম, বলতাম- ইনি সর্বশ্রেষ্ঠ বাগ্মী। আর যখন তিনি হাদীছ বর্ণনা করতেন, বলতাম- ইনি শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী।
আরও বহু সাহাবী ও তাবিঈ তাঁর জ্ঞানবত্তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁকে "হিবরুল-উম্মাহ' অর্থাৎ উম্মতের মহাপণ্ডিত বলা হয়ে থাকে। কেউ কেউ তাঁকে 'বাহর' (জ্ঞানের সাগর)-ও বলেছেন।
তিনি একজন বড় দানবীরও ছিলেন। তাঁর বাড়িতে মেহমানের ভিড় লেগে থাকত। তাঁর ছাত্র দাহহাক রহ. বলেন, ইবন আব্বাস রাযি.-এর গৃহে যত রুটি ও গোশত পাকানো হত, অতটা আর কোথাও দেখিনি।
তাঁর দানশীলতার বহু ঘটনা আছে। একটা ঘটনা একরম- হযরত আবু আইয়ূব আনসারী রাযি. একবার খুব ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বহু চেষ্টাতেও সে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে হযরত ইবন আব্বাস রাযি.-এর কাছে চলে আসেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার দেনার পরিমাণ কত? বললেন, বিশ হাজার দিরহাম। হযরত ইবন আব্বাস রাযি. তাঁকে চল্লিশ হাজার দিরহাম দিলেন, যাতে ঋণ পরিশোধের পরও তাঁর হাতে বিশ হাজার দিরহাম থাকে। সেইসঙ্গে দিলেন আরও বিশটি গোলাম।
তিনি অত্যন্ত আল্লাহভীরু লোক ছিলেন। প্রচুর ইবাদত-বন্দেগী করতেন। আল্লাহর ভয়ে এতবেশি কাঁদতেন যে, তাঁর দু' চোখের নিচে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। রাতের দীর্ঘ সময় ইবাদতের মধ্যে কাটাতেন।
তিনি হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে দু'বার দেখতে পেয়েছিলেন। একবার তিনি পিতার সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হন। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে কোনও কথা বললেন না। মজলিস থেকে উঠে যাওয়ার পর হযরত আব্বাস রাযি. পুত্র আব্দুল্লাহ রাযি.-কে লক্ষ করে বললেন, তিনি যে আমাদের সঙ্গে কোনও কথা বললেন না? পুত্র বললেন, আমি তাঁর কাছে এক ব্যক্তিকে দেখেছি, যাকে আমি চিনতে পারিনি। হযরত আব্বাস রাযি, আশ্চর্য হয়ে গেলেন এবং বললেন, কই, আমি তো কাউকে দেখিনি! শেষে তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলেন এবং এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, হাঁ, আমার কাছে তখন হযরত জিবরীল ছিলেন।
হযরত ইবন আব্বাস রাযি. শেষ বয়সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। শেষদিকে তিনি তায়েফে বসবাস করতেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। সেখানেই তিনি হিজরী ৫৮ সালে ইন্তিকাল করেন এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, যখন তাঁর লাশ দাফন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন কোথাও থেকে একটি বিরাট পাখি এসে তাঁর কাফনের মধ্যে ঢুকে যায়। সেখান থেকে পাখিটিকে বের হতে দেখা যায়নি। কেউ বলতে পারে না সেটি কোথায় গেল। দাফন করার পর তাঁর কবরের ওপর থেকে অদৃশ্য কণ্ঠে কুরআন মাজীদের এ আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করতে শোনা যাচ্ছিল-
يَاأَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ (27) ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً (28) فَادْخُلِي فِي عِبَادِي (29) وَادْخُلِي جَنَّتِي (30)
"(নেককারদেরকে বলা হবে, হে (আল্লাহর ইবাদতে) প্রশান্তি লাভকারী চিত্ত! নিজ প্রতিপালকের দিকে ফিরে আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে এবং আমার (নেক) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও আর দাখিল হয়ে যাও আমার জান্নাতে।সূরা ফাজর (৮১), আয়াত ২৭-৩০
তাঁর সূত্রে ১৬৬০টি হাদীছ বর্ণিত আছে।
নোট
মোট বর্ণনার সংখ্যাঃ 3835 আবাসস্থলঃ মদীনা মৃত্যুস্থানঃ তায়েফ