হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) এর জীবনী ২০২৪
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ)
হযরত আনাস রাযি.-এর উপনাম আবূ হামযা। তিনি আনসার সম্প্রদায়ের খাযরাজ গোত্রের লোক। তাঁর পিতার নাম মালিক ইবনুন নাযর। তাঁর মা হযরত উম্মু সুলায়ম রাযি. একজন বিশিষ্ট সাহাবিয়া ছিলেন। তিনি আনসারদের মধ্যে ইসলামগ্রহণে অগ্রণী নারীদের একজন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের কারণে তাঁর স্বামী মালিক ইবনুন নাযর ক্ষোভে-দুঃখে মদীনা ত্যাগ করে শামে চলে যান এবং সেখানেই তার ইন্তিকাল হয়। পরে হযরত আবু তালহা আনসারী রাযি.-এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁর ঘরেই হযরত আনাস রাযি. লালিত-পালিত হন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করে যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন তিনি দশ বছরের বালক। তাঁর মা তাঁকে এনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে পেশ করেন এবং আরয করেন, আপনি একে গ্রহণ করুন। আপনার ইচ্ছামত সে আপনার খেদমত করবে। তখন থেকে তিনি বাড়িতে থাকাকালে ও সফরে সর্বাবস্থায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করতে থাকেন। টানা দশ বছর খেদমত করেন। এ কারণে তিনি তাঁর খাস খাদেম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। হযরত আনাস রাযি. বলেন, আমি দশ বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করেছি। এর ভেতর তিনি কখনও আমাকে মারেননি, কখনও গালি দেননি এবং কখনও আমাকে লক্ষ্য করে ভ্রূকুঞ্চিত করেননি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সঙ্গে অনেক সময় রসিকতাও করতেন। আবূ দাউদ শরীফের এক বর্ণনায় জানা যায়, একবার রসিকতা করে তাঁকে বলেছিলেন, ওহে দুই কানওয়ালা! তাঁর মা যখন তাঁকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে পেশ করেন, তখন তিনি তাঁর জন্য দু'আ করেছিলেন- হে আল্লাহ! তুমি তাকে ধন ও জনে সমৃদ্ধি দিও এবং তাকে দীর্ঘায়ু দান কর।
নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দু'আর বরকতে তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন, প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছিলেন এবং তাঁর সন্তান-সন্ততিও ছিল অনেক। হযরত আনাস রাযি. বলেন, আল্লাহ তা'আলা আমার মালে এত বরকত দিয়েছেন যে, আমার আঙ্গুর বাগানে বছরে দু'বার ফল ধরে। আমার সন্তান-সন্ততি এত বেশি হয়েছে যে, আমার ঔরসজাত সন্তানের সংখ্যাই ১০৬জন।
বদরের যুদ্ধকালে তিনি মাত্র বার বছরের বালক। তাই এ যুদ্ধে তাঁর পক্ষে যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাদেম ছিলেন, তাই খেদমতের জন্য এ সফরে তিনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এছাড়া অন্যান্য যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাইআতুর রিযওয়ানেও শরীক ছিলেন। তাঁর পুত্র মূসা থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে মোট আটটি গাযওয়ায় শরীক থেকেছিলেন।
তিনি অত্যন্ত ইবাদতগুযার সাহাবী ছিলেন। এত দীর্ঘ নামায পড়তেন যে, তাতে তাঁর দু' পা ফুলে যেত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেভাবে নামায পড়তে দেখেছেন, হুবহু সেভাবেই পড়ার চেষ্টা করতেন। এজন্যই হযরত আবূ হুরায়রা রাযি, তাঁর সম্পর্কে বলেন যে, আমি রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামাযের সাথে তাঁর নামায অপেক্ষা বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ নামায আর কাউকে পড়তে দেখিনি।
তিনি যখন হজ্জ করতেন তখন যেন সম্পূর্ণ অন্য জগতের মানুষ হয়ে যেতেন। কোনওক্রমেই যাতে ইহরামের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হয়, সর্বপ্রযত্নে সেদিকে লক্ষ রাখতেন। তাঁর জনৈক সফরসঙ্গী বলেন, তিনি ইহরামের মর্যাদা রক্ষায় এতবেশি কঠোর ছিলেন যে, হালাল না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলাতে সাহস হয়নি।
নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাস খাদেম হওয়ায় অন্যান্য সাহাবীগণ তাঁকে বিশেষ মর্যাদা দান করতেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত জারীর ইবন 'আব্দুল্লাহ রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি সফরকালে হযরত আনাস রাযি.-এর সেবাযত্ন করতেন।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, নিজ খেলাফতকালে তাঁকে বাহরাইনে যাকাত আদায়ের দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। নিয়োগ দানকালে তিনি হযরত উমর রাযি.-এর কাছে এ কথা ব্যক্ত করলে হযরত উমর রাযি. বলেছিলেন, আপনি তাঁকে এ কাজের জন্য পাঠাতে পারেন, কারণ তিনি একজন বুদ্ধিমান লোক এবং ভালো লিখতে জানেন। হযরত ‘উমর রাযি.-এর আমলেও তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হযরত উমর রাযি.-এর আমলে তিনি বিভিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহেও শরীক থেকেছেন। তিনি তুসতার বিজয়ের একজন যোদ্ধা। এ যুদ্ধে তুসতারের নেতা হুরমুযান মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হলে হযরত আনাস রাযি. তাঁকে মদীনা মুনাওয়ারায় হযরত উমর রাযি.-এর কাছে নিয়ে এসেছিলেন। পরে হুরমুযান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
খলিফা 'আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ানের আমলে কুফার শাসনকর্তা হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ হযরত আনাস রাযি.-এর সঙ্গে ন্যাক্কারজনক আচরণ করেছিল। তিনি তাতে যারপরনাই দুঃখিত হন ও অপমানিত বোধ করেন। তিনি তাঁর মনের কষ্টের কথা খলিফা "আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ানকে লিখে জানিয়েছিলেন। তাতে বলেছিলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করেছি দীর্ঘ নয় বছর। যদি খ্রিষ্টান জাতি তাদের নবীর খেদমত করেছে –এমন কাউকে পেত, তবে তার কতই না সম্মান করত। আর আজ হাজ্জাজ কিনা আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করে! তাঁর চিঠি পেয়ে খলিফা 'আব্দুল মালিক হাজ্জাজের প্রতি ভীষণভাবে রুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হন। তারপর কঠোর ভাষায় হাজ্জাজের কাছে চিঠি লেখেন। তার সে চিঠিখানি আরবী পত্র-সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। সে চিঠি পড়ে হাজ্জাজের মত নিষ্ঠুর ও কঠোরপ্রাণ লোকও ধরধর করে কেঁপে উঠেছিল এবং কালবিলম্ব না করে হযরত আনাস ইবন মালিক রাযি-এর কাছে ক্ষমা চেয়েছিল।
হযরত আনাস রাযি. দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি বেশ শক্ত-সমর্থ ছিলেন। এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দু'আর বরকত।
দীর্ঘ দশ বছর যিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করেছেন, সফরে-বাড়িতে সবসময় সঙ্গে থেকেছেন এবং পেয়েছেন তাঁর অফুরন্ত স্নেহ-মমতা, তাঁর অন্তরে কী পরিমাণ নবীপ্রেম থাকবে তা সহজেই অনুমেয়। মুহূর্তের জন্যও তিনি প্রিয়নবীকে ভুলতে পারতেন না। তাঁর স্মৃতি নিয়েই জীবনের মুহূর্তগুলো পার করেছেন। সম্ভবত জাগ্রত অবস্থার স্মৃতিচারণার কারণে ঘুমের মধ্যেও তাঁকেই দেখতেন। তিনি তাঁর শিষ্য মুছান্না ইবন সা'ঈদকে লক্ষ্য করে বলেন, এমন কোনও রাত যায় না, যে রাতে আমি আমার প্রিয়তম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখি না। এই বলে তিনি কাঁদতে থাকেন।
শেষজীবনে তিনি বসরায় বসবাস করেন। সেখানেই তিনি হিজরী ৯৩ সালে ইন্তিকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৭ বছর। তাঁর সূত্রে ২২৮৬টি হাদীছ বর্ণিত আছে। তার মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয়ের গ্রন্থে আছে ১৮০টি। কেবল বুখারী শরীফে আছে ৮০টি এবং কেবল মুসলিম শরীফে ৯০টি।
এত দীর্ঘকাল যিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য পেয়েছেন, নিশ্চয়ই তিনি তাঁর কাছ থেকে শিক্ষাও লাভ করেছিলেন প্রচুর। এ কারণে তিনি একজন ফকীহ সাহাবী হিসেবেও গণ্য। এ হিসেবে তাঁর থেকে আরও অনেক হাদীছ বর্ণিত হওয়ার কথা। কিন্তু মাত্র ২২৮৬টি কেন? এর কারণ তাঁর বাড়তি সতর্কতা। তিনি যত জানতেন তত বর্ণনা করতেন না। তাঁকে তাঁর এক ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি আমাদের কাছে আরও বেশি বর্ণনা কেন করেন না? তিনি বলেছিলেন, বাছা! যে বেশি বলে, তার ভুল হয়ে যায়।
নোট
মোট বর্ণনার সংখ্যাঃ 2286 আবাসস্থলঃ বসরা। মৃত্যুস্থানঃ বসরা।