coinpayu

থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপন: পাশ্চাত্যের নগ্ন অনুকরণ ২০২৫

 

থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপন: পাশ্চাত্যের নগ্ন অনুকরণ

 লেখকঃ  মুফতী জহীরুল ইসলাম


নববর্ষের সূচনাতে আল্লাহ প্রেমিক মুমিনের অনুভূতি 

জানুয়ারী-'১৫ থেকে একটি নতুন সৌরবর্ষের সূচনা হতে যাচ্ছে। একটি বছরের সমাপ্তি এবং আরেকটি বছরের সূচনালগ্নে দাঁড়িয়ে একজন ঈমানদার বান্দার অনুভূতি কী হওয়া উচিত? আনন্দের না বেদনার, চিন্তার না গাফলতের? তার তো চিন্তা হওয়া উচিত, আমার নওরোজ হল প্রতিদিন। প্রতিদিনের ভোর আমাকে দান করে মহান রাব্বুল আলামীনের শোকর গোযারীর প্রেরণা, একটি নতুন দিবসের উদ্দীপনা এবং জীবনসন্ধ্যার প্রস্তুতির চেতনা। সুতরাং বর্ষপঞ্জির একটি বা দু'টি দিন নয়, জীবনের প্রতিটি দিনই মুমিনের উৎসবের দিন।

সে ভাববে, যে দিনগুলো শেষ হয়ে গেল তা তো আমার জীবনেরই একটি অংশ। আজ আমার জীবনের একটি ক্যালেন্ডার শেষ হয়ে গেল। হায়! গত ৩৫৬ দিনে আমার জীবনপ্রাসাদ থেকে ৩৬৫টি ইট খসে পড়ল। হায়! আমার জীবন তো ছোট হয়ে এলো। এ-তো আমার আনন্দের বিষয় নয়, চিন্তার ব্যাপার; নিজের হিসেব নিজে নেয়ার ব্যাপার। হায়! জীবনের একটি বছর আমি কীভাবে কাটালাম? কোন গাফলতে আমার পরম পুঁজি নষ্ট করলাম? যে উদ্দেশ্যে আমাকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে তার কী বিহিত করলাম? তো এটা হল এ জাতীয় বিষয়ের হিসেব মেলানোর সময়।

মুমিনের সংকল্প

একটি বছরের উপসংহারে দাঁড়িয়ে, একটি বছরের সর্বশেষ দিনের সাক্ষী হয়ে একজন আল্লাহ প্রেমিক মুমিনের অন্তরে এ প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হওয়া দরকার, আর সংকল্প ও পরিকল্পনা করা দরকার যে, আগামী বছর সে কিভাবে কাটাবে? এবারের ব্যর্থতাকে কিভাবে সাফল্যে পরিণত করবে? জীবন সংগ্রামের বন্ধুর পথে কিভাবে মঞ্জিলে পৌঁছবে? কাজেই উদ্দেশ্য ও গন্তব্য বিস্মৃত ব্যক্তি যেভাবে নতুন ভোরের কল্পনায় আনন্দিত হয়, নতুন প্রভাতে নতুন সূর্যোদয় দেখার প্রতীক্ষায় থাকে, খোদার পথের পথিক তো সেভাবে নতুন ভোর দেখার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করতে পারে না। বছর শেষে নতুন আরেকটি বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য সে রং তামাশা আর আনন্দ উল্লাস করতে পারে না। সে তো নিজেকে প্রশ্ন করবে, আমি কোথা হতে এসেছি? কেন এসেছি? কী করছি আর যাব কোথায়?



আমলনামার ব্যালেন্সশীট তৈরি করা 

হাদীসে পাকে বর্ণিত আছে,

حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا وتزينوا للعرض الأكبر وإنما يخف الحساب يوم القيامة على حاسب نفسه في الدنيا

অর্থ : হিসাব চাওয়ার পূর্বে নিজের হিসাব করে নাও। তোমার কাজের পরিমাপ করার পূর্বেই তুমি নিজের কাজের পরিমাপ করে নাও। (সুনানে তিরমিযী; ৪/৬৩৮)

এ হাদীসের মর্মার্থ হল, হে মানুষেরা! একটু পরেই তোমাদের হিসাব শুরু হয়ে যাবে। তখন পূর্ণ হিসাব বুঝিয়ে দিতে হবে। কাজেই হিসাব নেয়ার পূর্বেই তুমি তোমার ব্যালেন্সশীট তৈরি করে রাখ। আজকের এই দিনে একজন মুমিন হিসেবে আমার আমলনামার ব্যালেন্সশীট তৈরি করা দরকার। একটি মোমবাতি যেমন তিলে তিলে ছোট হতে হতে শেষ হয়ে যায় তেমনি দিনের আগমন ও রাতের প্রস্থানে আমাদের জীবনের মোমবাতিটি ছোট হতে হতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের জীবন আমরা কিভাবে ব্যয় করছি তার হিসাব আমাদেরকে করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, اقترب للناس حسابهم وهم في غفلة معرضون অর্থ : মানুষের হিসাবের সময় তো খুব নিকটেই। অথচ তারা গাফলতিতে ডুবে বিমুখ হয়ে আছে। (সূরা আম্বিয়া-১)

প্রিয় বন্ধু! মহাকালের তুলনায় তোমার আমার ৬০/৭০ বছর কিছুই না। বিন্দু বা কণার মত দেখাও যাবে না। তাই আমাদের জীবনের হিসাবের সময় অতি নিকটে। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, من مات فقد قامت قيامته অর্থ : যে ব্যক্তি মারা গেছে তার কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে। (তাফসীরে কুরতুবী ১৯/১৮৮)

আল্লাহর ওলীগণ প্রতিদিন আমলের হিসাব নেন

আমার মৃত্যু কখন হবে? তাতো আমি জানি না! তাই এখনই হিসাব কষে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। এ জন্যই আল্লাহর ওলীগণ প্রতিদিন নিজের হিসাব গ্রহণ করতেন।

'হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহ.কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আল্লাহর ওলীর মর্যাদা আপনি কিভাবে লাভ করেছেন? তিনি বলেছিলেন, ত্রিশ বছর পর্যন্ত প্রতি রাতে নিজের আমলের হিসাব নিয়েছি। এই হিসাব নেয়ার প্রেক্ষিতেই আল্লাহ পাক আমাকে এই মর্যাদা দান করেছেন। (প্রাগুক্ত)

এটাকেই বলা হয় 'মুহাসাবা' বা নিজের হিসাব গ্রহণ। বছর শেষে তাই হিসাব নিতে হবে, ভালো কাজে আমি কতটুকু অগ্রসর হলাম? ন্যায়ের পথে আমি কতটুকু অবদান রাখলাম?

আল্লাহর ওলীগণ নিজের মনকে ডেকে বলেন, হে মন! কিভাবে তোমার আনন্দ, উল্লাস করতে ইচ্ছে হয়? কত মানুষের লাশ না তুমি দেখেছো! কত কাফনাবৃত শবদেহ না তুমি অবলোকন করেছো! হে আত্মা! তোমার কি মনে হয় না, তোমাকে একদিন এই জানাযার খাটে উঠতে হবে? হে পাষাণ! এত লাশ দেখেও, এত কবর দেখেও তোমার সম্বিৎ ফিরে না যে, এই মাটির নিচে তোমাকেও একদিন যেতে হবে? অন্ধকার, নির্জনতা, একাকিত্ব আর কীট- পতঙ্গের ঘরে তোমাকেও একদিন শুতে হবে? তাহলে থার্টিফাস্ট নাইটে তোমার কেন এত উন্মাদনা? তুমি কি চাও এই উন্মাদনার মধ্যেই তোমার কাছে মালাকুল মউত চলে আসুক? না কি এ গ্যারান্টি আছে, মালাকুল মউত এ সময় তোমার কাছে আসবে না?

সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. বলেছেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা করো না। আর সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। সুস্থাবস্থায় অসুস্থ সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে নাও। হে আল্লাহর বান্দা! তোমার জানা নেই কাল তোমার কী অবস্থা হবে? (সুনানে তিরমিযী; ৪/৫৬৮)

বাংলাদেশে থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপন 

পাশ্চাত্যে থার্টিফাস্ট নাইটে আনন্দ, ফুর্তি ও জাঁকজমকের সাথে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করা হয়। বিজাতীয় এ হাওয়া এখন আমাদের গায়েও লেগেছে। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে ৩১ ডিসেম্বর রাত বারোটার পর থেকে এ রাত উদযাপন উপলক্ষে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে যায়। নাইট ক্লাব, গেস্ট হাউজ, অফিসার্স ক্লাব ও লেডিস ক্লাবগুলো উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ তরুণ-তরুণীর নাচ- গানে জাহান্নাম হয়ে ওঠে। সেই সাথে শুরু হয় বিয়ার, হুইস্কি, ফেন্সিডিল, আফিম, হেরোইন, ইয়াবা, গাজাসহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্য সেবনের মহাধুম। এ সময় তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় যৌন উন্মাদনা। ধীরে ধীরে ক্লাব, সেমিনার আর পার্কগুলো পরিণত হয় ভাসমান পতিতালয়ে। এভাবে প্রতি বছর এক রাতে কত নারীর ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়, তা একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। আজ বর্ষ উদযাপনের নামে যে বিকৃত রুচির পরিচয় দেয়া হচ্ছে এবং বেহায়া-বেলেল্লাপনার প্রসার ঘটানো হচ্ছে তার পরিণতি কী দাঁড়াচ্ছে তা কি কখনো ভেবে দেখেছি? এ রাতে রাস্তাঘাটে মদের বোতল আর নারী নিয়ে প্রকাশ্যে যেসব নোংরা কর্মকাণ্ড ঘটানো হয় মিডিয়ার কল্যাণে তার চিত্র প্রত্যক্ষ করে বিবেকবান কোন মুমিন শিহরিত না হয়ে পারে?

অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, বাংলাদেশের মত একটি বৃহত্তর মুসলিম রাষ্ট্রে থার্টিফাস্ট নাইটে তরুণ-তরুণীদের উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ, র‍্যাব নিযুক্ত করতে হয়। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী হোটেল রূপসী বাংলায়, সোনারগাঁওয়ে ও অন্যান্য অভিজাত হোটেলগুলোতে থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপনের জন্য চড়া দামে টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর টিকেটের দাম অনেক চড়া। কারণ, তারা জানে দাম যতই হোক 'সাপ্লাই' পর্যাপ্ত হলে কাস্টমারের অভাব হবে না, তাদের বিনিয়োগ বিফলে যাবে না। প্রশ্ন হল, এসব হোটেলে রাত্রি যাপনের জন্য, ঐ নোংরা আয়োজনে অংশগ্রহণের জন্য কি বিদেশ থেকে লোকজন আসবে? শুধু বিধর্মীরাই কি যাবে ঐ হোটেলগুলোতে? আফসোস! এ দেশে এমনও মুসলমান আছেন যারা এই একটি রাত উদযাপনের জন্য হাজার, লক্ষ টাকা ধ্বংস করবেন। সারারাত নেশায় বুদ হয়ে নৃত্য-গীত উপভোগ করবেন এবং আকণ্ঠ পাপে ডুবে থাকবেন।

২০০০ খ্রিস্টাব্দের থার্টিফাস্ট নাইটের কথা কি মনে পড়ে? সেবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাঁধন নামের এক ছাত্রীকে রীতিমত দিগম্বর করে ফেলা হয়েছিল! মিডিয়ার মারফতে সারা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল আমাদের জাতীয় অধঃপতনের সে কদর্য দৃশ্য। এ ঘটনায় শুধু একটি মেয়েকেই কলঙ্কিত করা হয়নি; এ কলঙ্ক ছিল সমস্ত বাংলাদেশী মুসলমানের। আমাদের যে ছবি বহির্বিশ্বে সেদিন প্রচারিত হয়েছে তা ছিল এ দেশের ষোল কোটি মানুষের জন্য যুগপৎ লজ্জা ও অপমানের।

ভাবতে অবাক লাগে, এ কলঙ্কের জন্মদাতারা কিন্তু অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ ছিল না, তারা ছিল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্রবৃন্দ। যারা কদিন পরদেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিবে, ক্ষমতা ও প্রশাসনের চেয়ারগুলো অলঙ্কৃত করবে- এ ছিল তাদের আচরণ।

বস্তুত কোন মুসলমান নর-নারী থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপনের জন্য হোটেল সোনারগাঁও আর রূপসী বাংলায় যেতে পারে না। কোন কনসার্টে এবং গান-বাজনায় অংশ নিতে পারে না। যার অন্তরে ঈমানের সামান্য আলোও আছে থার্টিফাস্ট নাইট তার জন্য নয়। তাদের এই দিন উল্লাসের নয়। এই দিন তাদের হিসাব-নিকাশের দিন। আল্লাহকে যারা ভয় করে নতুন বছরের সূচনায় তারা নিজেদের আমলের দফতর খুলে হিসাব নিবে। মন্দ কাজের জন্য নিজেকে তিরস্কার করবে আর সৎ কাজে মনোযোগী হওয়ার প্রতিজ্ঞা করবে।

থার্টিফাস্ট নাইট বিজাতীয় উৎসব 

থার্টিফাস্ট নাইট মুসলমানদের উৎসব নয়; আমদানীকৃত বিজাতীয় কালচার। আর বিজাতীয় উৎসবে যারা অংশগ্রহণ করবে তারা তাদেরই দলভুক্ত হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটিকে এভাবে বলেছেন, من تشبه بقوم فهو منهم অর্থ : যে অন্য জাতির আচার-আচরণ ও কৃষ্টি-সংস্কৃতি অনুকরণ করবে (পরিণামে) সে তাদেরই একজন বিবেচিত হবে। (সুনানে আবূ দাউদ) 

আমরা তো মুসলমান। থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপন ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিজাতীয় প্রথার সাথে ইসলামের সামান্যতম সম্পর্কও নেই। এ ধরনের নববর্ষ বা বর্ষপূর্তি উদযাপনের এমনকি জন্ম বার্ষিকী বা মৃত্যু বার্ষিকী পালন করারও কোন বিধান ইসলামে নেই। ইসলাম এমন রুচিহীন, অর্থহীন ও বল্গাহীন আচারসর্বস্ব ধর্ম নয়। ইসলামের প্রতিটি শিক্ষাই অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। সকল কাজে ইসলামের নিজস্ব নিয়ম-নীতি ও স্বতন্ত্র পথ-পদ্ধতি রয়েছে। সুস্থ, সুন্দর, গাম্ভীর্যপূর্ণ তাহজীব-তামাদ্দুন ইসলামের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইসলামী আচার-আচরণ ছেড়ে এসব জাহান্নামী আয়োজন কখনো কোন মুসলমান কল্পনা করতে পারে না। প্রগতিবাদী ষড়যন্ত্রে নামক বিজাতীয় দুর্গতিবাদীদের কৃষ্টি-কালচারে একজন খোদা প্রেমিক মুমিন অভ্যস্ত হতে পারে না।

কিন্তু বর্তমানে ইসলামের কালেমায় দীক্ষিত ব্যক্তিদেরকেই নিজেদের আচার- অনুষ্ঠানে বিজাতীয় শিক্ষা সংস্কৃতি, তাদের অভ্যাস ও নীতি-নৈতিকতা অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে। প্রতি বছর থার্টিফাস্ট নাইটে আমাদের দেশে যেসব কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে তার সাথে মুসলমানিত্বের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এ সময় এ দেশের মুসলমান যেভাবে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে মেতে ওঠে তাতে এটা যে একটা মুসলিম রাষ্ট্র তা বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। সে রাতের মাতলামী কেবল পাশ্চাত্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

দুঃখের সাথে বলতে হয়, এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান। ইসলামী সংস্কৃতি এ জাতির হাজার বছরের লালিত ধন। আলেম-উলামা ও বুযুর্গানে দীনের চোখের পানিতে এ অঞ্চলের ভূমি সিক্ত-সজীব। একটি জাতির আবহমান কালের আচরিত সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে পাশ্চাত্য থেকে বয়ে আনা নোংরা আচার অনুষ্ঠানকে গোটা জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেয়া কখনোই সঙ্গত হতে পারে না।

তথাকথিত আধুনিক শ্রেণীর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণ

'আধুনিক' পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধকারী মুসলমান আজ ইসলামের আলোকময় সভ্যতা পরিহার করে বিকৃত পাশ্চাত্যকে নিজেদের জীবনে ধারণ করেছে। নির্বিচার পরানুকরণের ফলে এদের বোধশক্তি ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে। এদের বিবেক-বোধের কথা ভাবলে দুঃখ হয়। ক্রমেই তারা যেন অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তা অনুভবও করতে পারছেন না। অবশ্য পরিবেশ, সামাজিকতা ও পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে অবচেতন মনেও কেউ কেউ বিকৃত সভ্যতার অনুকরণে জড়িয়ে পড়ছেন। এ দেশের মুসলিম তরুণ-তরুণীদের অধিকাংশ এভাবেই পরানুকরণের শিকার হচ্ছেন। নির্বিচারে অনুকরণ প্রবণতার সবচেয়ে ক্ষতির দিকটি হল, এতে একটি জাতি তার স্বকীয়তা ও আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলে।

তখন পরের পথকেই নিজের পথ বলে মনে হয়। আপন হয় পর আর পর হয়ে যায় আপন। বন্ধুকে শত্রু আর শত্রুকে বন্ধু মনে হয়। উন্নতিকে মনে হয় অবনতি আর অবনতিকে মনে হয় উন্নতি। এভাবে ধর্মীয় ও জাতীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত অংশের সাথে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ফলে উন্মুক্ত হয় জাতির আত্মকলহের পথ।

বর্তমানে সমাজের এলিট শ্রেণীর মধ্যে পাশ্চাত্য রীতিনীতির অনুকরণ প্রবণতা এতটাই প্রবল আকার ধারণ করেছে যে, ওরা যত অযৌক্তিক ও অনৈতিক প্রথাই উদ্ভাবন করুক না কেন, তারা তা মাথা পেতে গ্রহণ করবে এবং সমাজে তার প্রচলন ঘটাতে সচেষ্ট হবে।

অবস্থা এতদূর গড়িয়েছে যে, যারা নিজেদের জীবনে মোটামুটিভাবে ধর্মচর্চা করেন, ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা কুরআন- হাদীসের আলোকে তুলে ধরলে কিছুটা প্রভাবিত হন তারাও এখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চায় আক্রান্ত।

আমাদের চিরায়ত ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য সভ্যতার এ নগ্ন আগ্রাসন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রায় সর্বত্রই তার সরব উপস্থিতি চোখে পড়ছে। অশ্লীল চলচিত্র প্রদর্শন, বিজ্ঞাপনে অশালীনভাবে নারীদের ব্যবহার, শুভ সন্ধ্যা ও গুডমর্নিং চর্চা, টাই ব্যবহার, এক মিনিটের নীরবতা পালন, স্মরণীয় ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি নির্মাণ, লাশ বা কফিনে পুষ্পাঞ্জলি-শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান, মৃতের প্রতি শোক প্রকাশের জন্য বিউগল বাজানো, মৃতের স্মরণে গান-বাদ্য করা, অসহায়দের সেবার জন্য নৃত্য অথবা গান-বাজনার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা, বাসস্থান এমনকি শয়ন কক্ষে কুকুর পালন এবং কুকুরের সাথে দৃষ্টিকটু সখ্যতা ইত্যাদি অপসংস্কৃতি এখন আমাদের নগর জীবনে সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়ছে।

মোটকথা, আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতিতে যে সর্বগ্রাসী বিপর্যয় নেমে এসেছে তা দীনীমূল্যবোধের অধিকারী বিবেকবান ব্যক্তির অন্তরে নাড়া না দিয়ে পারে না। 

শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজ ও বিবেকবান দায়িত্বশীলগণের করণীয় 

এমতাবস্থায় দেশের শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজ ও অন্যান্য বিবেকবান দায়িত্বশীলগণ যদি এখনই পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ান এবং আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ না হন তাহলে এ অসভ্যতা ক্রমান্বয়ে পুরো জাতিকে গ্রাস করে ফেলবে। কারণ, শহরে যে সংস্কৃতির চর্চা হয় খুব দ্রুত তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যায়। শিশু-কিশোর, পৌঢ়-যুবক, আবাল-বৃদ্ধ কেউ তার অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।

সুতরাং আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অপসংস্কৃতি আর অসভ্যতা ছড়িয়ে পড়েছে তা রোধ করতে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

আমরা যেন সকল অপসংস্কৃতির বেড়াজাল ছিন্ন করে যথার্থ ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত হই এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করি এটাই হোক প্রতিটি নববর্ষের আন্তরিক কামনা।
পূর্ববর্তী পোষ্ট পরবর্তী পোষ্ট
coinpayu
coinpayu
coinpayu
coinpayu